কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তবাঞ্চল কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। সারা দিন একবারো সূর্যের দেখা মেলে না। তাপমাত্রা কমে গেছে স্বাভাবিকের চেয়েও কম। এই আবহাওয়ায় মাঠের ফসল, বিশেষ করে আলু ও টমেটোতে দেখা দিয়েছে মড়ক রোগ। রোগটি আসলে লেট ব্লাইট বা নাবী ধসা। দিনে-রাতে কুয়াশা থাকায় তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি আর্দ্রতাও বেড়ে যাওয়ায় এই রোগের জীবাণু দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। সপ্তাহ খানেক পর দিনে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর রোদ দেখা দিলেও রাতে আবার কুয়াশা পড়ায় মড়ক রোগের জীবাণুর বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের আলু ও টমেটো ক্ষেতে এবার এই রোগ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে চাষি ভাইয়েরা সমস্যায় পড়বেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাঠের সমস্যা দেখে অনেক চাষি একই ক্ষেতে একাধিক ছত্রাকনাশক পর পর ব্যবহার করছেন। এতে কাজ হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়। আবার অনেক স্থানের চাষিরা কৃষি অফিস বা কৃষিবিদদের সাথে যোগাযোগ ছাড়াই দোকান থেকে নিজেরাই বা দোকানদারদের পরামর্শে ভুল ছত্রাকনাশক কিনে ব্যবহার করে প্রতারিত হচ্ছেন। আসলে নাবী ধসা রোগ হওয়ার আগের পরিবেশ এবার আবহাওয়ার কারণেই তৈরি হয়েছিল।
সে কারণে কুয়াশা দেখা দেয়ার সাথে সাথে যারা মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ৩ থেকে ৪ দিন পর পর ব্যবহার করেছেন তাদের ক্ষেত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্ত এই সময়ে যারা কোনো ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেননি, এবং গাছে সমস্যা দেখা দেয়ার পর মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন তাদের বেলায় এই ছত্রাকনাশক কোনো কাজ করেনি। কারণ একবার রোগাক্রান্ত হলে মেনকোজেব কোনো কাজ করে না। তখন অন্য গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন, মেনকোজেব+ মেটালাক্সিল বা প্রপিনেব+ আইপ্রোভেলিকার্ব বা ফেনামিডন+ মেনকোজেব) ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই নিকটস্থ কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা উচিত।
এখানে লেট ব্লাইট বা মড়ক রোগের কারণসহ লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো।
রোগের কারণ ও লক্ষণঃ এক ধরনের ছত্রাকের কারণে রোগটি হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাতা, পাতার বোঁটা, ডগা ও কাণ্ডে ছোট ছোট পানি ভেজা আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে এই দাগ প্রথমে বাদামি ও পরে কালো রঙ ধারণ করে। এরপর দাগ আরো বড় হয়ে সব পাতা, ডগা ও কাণ্ডের চার দিকের বেশ কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। আক্রান্ত দাগের চার দিকে ফ্যাকাশে সবুজ ও বাদামি রঙের বলয় দেখা যায়। পাতার নিচে সাদা সাদা গুঁড়োর মতো জীবাণু দেখা দেয়। এই জীবাণু সামান্য বাতাসেই উড়ে গিয়ে অন্য সুস্থ গাছের পাতা ও ডগা সংক্রমণ করে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি (৯০-১০০%) থাকলে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতের অধিকাংশ গাছ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ক্ষেতে এক ধরনের বিশেষ গ বা পোড়া গ পাওয়া যায়। ক্ষেত দেখে মনে হয় সমস্ত আলুগাছ পুড়ে গেছে। টমেটোর ফল আক্রান্ত হলে বোঁটার কাছাকাছি জায়গা থেকে কালো দাগ পড়ে এবং পচন শুরু হয়।
উপযোগী পরিবেশঃ রাতের তাপমাত্রা ১০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০-১০০% হলে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রোগ সংক্রমণের পর ২১ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রোগ আরো বৃদ্ধি পায়।
বিস্তারঃ আক্রান্ত টমেটো বা আলু বীজের মাধ্যমে এই ছত্রাক পরের বছরে রোগ ছড়ায়। অনেক সময় আক্রান্ত টমেটো বা আলুগাছ থেকেও এই রোগ সুস্থ টমেটো বা আলুগাছে ছড়ায়। এই রোগের বীজাণু বা স্পোর বাতাস ও পানির ছিটার মাধ্যমে ক্ষেতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাঃ আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ না নেয়া উচিত। প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করতে হয়। ক্ষেত সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হয়। ফসল তোলার সময় আক্রান্ত গাছ ও পাতা যেন টিউবার বা কন্দের সাথে না লাগে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। রোগাক্রান্ত সম্পূর্ণ আলুগাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। রোগাক্রান্ত আলুবীজও মাটিতে পুঁতে ফেলা উচিত। আক্রান্ত ক্ষেতের আলুগাছ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর আলু তুললে পাতায় অবস্থিত ছত্রাক মরে যায়, ফলে টিউবার বা কন্দ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমে যায়। গাছের গোড়ার মাটি উঁচু করে দিলে মাটির নিচের আলুকে রোগ-বীজাণু থেকে রক্ষা করা যায়। বৃষ্টির পর বা ভেজা মাটিতে কখনো আলু তোলা উচিত নয়, এতে পাতা ও মাটি থেকে আলু সংক্রমিত হতে পারে। আলু তুলে ফেলার পর পরিত্যক্ত অংশগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আগাম জাতের আলু চাষ করলে অনেকাংশে এই রোগ এড়ানো যায়। যেসব এলাকায় প্রতি বছর বা প্রায়ই এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয় সে সব এলাকায় আলুর গাছ ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার হলেই ২০ থেকে ২২ দিন পর পর বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব বা কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। আক্রান্ত ক্ষেতে যথাসম্ভব সেচ প্রদান ব রাখতে হয়। সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
টমেটো বা আলু ক্ষেত আক্রান্ত হলে মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে অ্যাক্রোবেট এমজেড (ডাইমেথোমর্ফ + মেনকোজেব) অথবা মেলোডি ডিউ (প্রোপিনেব + আইপ্রোভেলিকার্ব) অথবা রিডোমিল গোল্ড এমজেড (মেটালাক্সিল এম + মেনকোজেব) আলু ক্ষেতে স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার সময় পাতার উভয় দিকসহ সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে দিতে হয়। এই ছত্রাকনাশকগুলোর যেকোনো একটি ৭ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হয়। যদি কুয়াশা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে যত দিন কুয়াশা থাকে তত দিন সপ্তাহে ২ বার স্প্রে করা ভালো।
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত