গোলাপকে ‘পুষ্পরানি’র সিংহাসনে অভিষিক্তকারিণী সাফো। কী গোলাপ দেখে সুপ্রাচীন এই গ্রিক কবি উচ্ছ্বসিত গোলাপ-প্রশস্তি লিখে ফুলের সিংহাসনে গোলাপকে চিরস্থায়ী করলেন এবং নিজেও গোলাপের মতোই নিত্য উদ্ধৃত রইলেন?
প্রথমে গোলাপের লিখিত ইতিহাসটা একনজর দেখা যাক। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তবিংশতি শতকী সারগনের আমলের রাজসমাধিভূমে স্যার লেনার্ড উলির প্রাচীনতম আবিষ্কার-পরবর্তী বেশ কটি শতাব্দীই পুষ্পরানির দলিলবিহীন। তবে ধরে নেওয়া চলে যে ইরাকি-তুর্কি মাতৃভূমি থেকে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে তার জয়যাত্রা শুরু করে জলে-স্থলে বাণিজ্যপথ ধরে উদ্যমী পুষ্পটি পৌঁছে গিয়েছিল ক্রিটে, গ্রিসে, আফ্রিকার উত্তরে, মিসরে—সওদাগরি কারোয়ানের সখের সঙ্গিনী হয়ে। এমনি করে হাজার বছর ধরে অলখে লুকিয়ে থাকার পরে অবশেষে গোলাপের দেখা মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ষোলো শতকের ক্রিটের দেয়ালচিত্রে আর মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবিতে।
খ্রিষ্টের সাত শ বছর আগের মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসির দুটিতেই গোলাপের উল্লেখ রয়েছে, তবে বিশেষ গোলাপের নয়, গোলাপবিশেষের। শৈলীগত বাগ্ভঙ্গিমায়—যেমন ‘দ্য রোজি ফিঙ্গারড ডন’। হোমারের বর্ণনায় অ্যাকিলিসের ঢাল ছিল গোলাপখচিত, নিহত হেক্টরের সর্বাঙ্গে আফ্রোদিতি লেপন করেছিলেন গোলাপেরই মলম। প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি এবং রোমান দেবী ভিনাস—উভয়ের প্রতি উৎসর্গিত পুষ্পটি ছিল বিকল্পহীন গোলাপ। গ্রিসের স্মির্নাবাসী হোমারের গোলাপগুলো ছিল অবশ্যই সাদামাটা প্রাকৃতিক গোলাপ।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে গ্রিসের লেসবসবাসিনী গীতিকবি সাফোর (খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০-৫৮০) বাণীবন্দনাতেই পুষ্পকুলের রানিরূপে প্রথম অধিষ্ঠান গোলাপের। সেই থেকে, বিগত ২৭০০+ বছরের ইতিহাসে, এই পৃথিবীতে গোলাপই একমাত্র রাজন্য যিনি তাঁর রাজমুকুটখানি হারাননি—বরং সাম্রাজ্যটিও নিরবধিই বিস্তার করে চলেছেন।
লেসবসের এই কালজয়ী গীতিকবির যে গানে গোলাপের পুষ্পরানি হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল সেটির উদ্ধৃতি দেওয়া গেল সরাসরি গ্রিক থেকে ইংরেজি অনুবাদে:
Song of Rose
‘Would Jove appoint some flower to reign,
In matchless beauty on the plain,
The Rose (mankind will all agree),
The rose the queen of flowers should be;...
(Translation : F. Fawkes)
পরবর্তীকালের কবি, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের অ্যানাক্রিয়নের স্তবগানে গোলাপের ধরাধামে আবির্ভাব বর্ণিত হয়েছে সবিস্তারে—যেমন কীভাবে প্রেমদেবী আফ্রোদিতির সমুদ্র থেকে অভ্যুত্থানের অভিঘাতপ্রসূত শুভ্র সমুদ্রফেনা থেকে অভ্যুদয় ঘটেছিল তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি গোলাপের। এ কবির গোলাপও ছিল প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক মূল্য সংযোজিত নয়।
গোলাপকে ‘পুষ্পরানি’র সিংহাসনে অভিষিক্তকারিণী সাফোর এ গান যতবার পড়ি ততবারই ভালো লাগে এবং ততবারই প্রশ্ন জাগে: কী গোলাপ দেখে সুপ্রাচীন এই গ্রিক কবি এমন উচ্ছ্বসিত গোলাপ-প্রশস্তি লিখে ফুলের সিংহাসনে গোলাপকে চিরস্থায়ী করলেন এবং নিজেও গোলাপের মতোই নিত্য উদ্ধৃত রইলেন? তাঁর দেশ ও কালের খ্যাতিমান অন্য কবি কি সে গোলাপ দেখেননি? যেমন তাঁর সমসাময়িক কবি আলসিউস? যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন সমকালীন রাজনৈতিক ডামাডোল নিয়ে লিখে?
আগে দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব দেওয়া যাক। আসলে যার যা দেখার তিনি তা-ই দেখেছেন। রোমান্টিক প্রকৃতির ইন্দ্রিয়সেবী গীতিকবি সাফো মানুষের দলাদলির বদলে গোলাপের ঢলাঢলি দেখেছেন। যেমন দেখেছেন পারস্য কবি ওমর খৈয়াম (খ্রিষ্ট ১০৪৮-১১৩১)। তিনিও গোলাপ নিয়ে মাতামাতি করেছেন সরল সৌন্দর্যের প্রতীক প্রাকৃতিক গোলাপ দেখে।
জটিল সৌন্দর্যের গোলাপ নিয়ে প্রথম কাব্য রচনা করেছেন সম্ভবত চীন দেশের সং বংশের রাজত্বকালের (৯৬০-১২৭৯) কবিকুল, যাঁদের দেশে তাঁদের কালের আগে থেকেই প্রকৃতির কাজে হাত লাগিয়ে সংকর-প্রজনকগণ সিঙ্গেল গোলাপের বহুগুণ বেশি পাপড়িসংবলিত একালের সেমিডাবল, ডাবল, ফুল, ভেরি ফুল ইত্যাদি সংজ্ঞায়িত গোলাপের জটিল সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।
ওমর খৈয়ামের কবিতাকে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন ফুলের মতো ফুটে ওঠা দর্শন, যেমন হালকা, যেমন ফুরফুরে, তেমনি সুন্দর, তেমনি রঙিন:
‘এর প্রতিটি হচ্ছে ইরানদেশের গোলাপ,—এ গোলাপের রঙের সম্বন্ধে ওমর জিজ্ঞাসা করেছেন, “দীর্ণ-হিয়া কোন সে রাজার/ রক্তে নাওয়া এই গোলাপ—/ কার দেওয়া সে লালচে আভা,/ হূদয়-ছ্যাঁচা শোণিত-ছাপ’। ওমরের কবিতার রস ফুলের আসব, সে রস পান করলে মানুষের মনে গোলাপি নেশা ধরে...।’
যেমন কান্তি ঘোষের অনুবাদে:
সদ্য ফোটা এই যে গোলাপ, গন্ধ-প্রীতি-উজল মুখ,
বলছে না কি—মিথ্যা এসব, এই ক্ষণিকের দুঃখ সুখ।
পৃথ্বী-বুকে উঠছে ফুটে গর্্বে পরি রঙিন সাজ—
—পাপড়ি টুটে ছড়িয়ে মোদের জীবন-রেণু পথের মাঝ।
ঐহিক প্রেমী ওমরের (যিনি বলেন ‘নগদ যা’ পাও হাত পেতে নাও,/ বাকির খাতায় শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে?/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক) নগদ চাহিদার তালিকায় গোলাপের বাইরে আছে শুধু একটি দিওয়ান, মানে একটি কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যও আমার মতে কেবল একটি শৈলীর, তথা গজল নামক গীতিকবিতার—যা সুর সহযোগে শ্রাব্য।
উল্লেখযোগ্য গজল রচনার সূচনা বস্তুত জ্যোতির্বিদ কবি এই ওমর খৈয়াম থেকেই। আজ পর্যন্তও ফারসি কাব্যের শ্রেষ্ঠতম ফসল গজল। বলা হয়, ‘পারস্য হয়ে ভারতবর্ষে আগত মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম উপহার তাজমহলের পরে গজল।’
আসল কথা কাব্যজগতের ঐহিক প্রেমের একমাত্র ঘরানা গজলই মেলে পুষ্পভুবনের জাগতিক প্রেমের একমাত্র সখী গোলাপের সঙ্গে। গজলের প্রতিটি দ্বিপদী সার্বভৌম একটি শব্দার্থগত সত্তা, একটা আলাদা কবিতা। তেমনি প্রতিটি গোলাপও যেন স্বতন্ত্র একটি নন্দনতত্ত্বগত সত্তা, জনৈকা অন্যরূপা নায়িকা।
এ জন্য আমার মনে হয়—প্রতিটি গোলাপ যেন একটি গান। আবার প্রতিটি গানই যেন একটি গোলাপ। পুষ্পের ভুবনে যেমন কেবল গোলাপই দৈহিক প্রেমের অবিমিশ্র প্রেরণা, কাব্যের জগতেও তেমনি কেবল গজলই শরীরী প্রেমের অবিমিশ্র অভিব্যক্তি—তবে কেবল অপুরস্কৃত প্রেমের। কিন্তু যত পুরস্কারহীনতার হাহাকারই হোক না কেন গজল, তার কাঙ্ক্ষিত প্রতিদান অবশ্য ইন্দ্রিয়জ বাসনারই। গোলাপও এমনি ইন্দ্রিয়জ বাসনারই প্রতীক।
তেমনি ইন্দ্রিয়জ কামনার প্রতিমূর্তি গীতিকবি সাফোই তো হবেন গোলাপের সমঝদার, গাইবেন গোলাপের গান। যেমন তাঁর রাজনৈতিক গোলযোগপূর্ণ কালের অন্য কবি লিখেছেন রাজনৈতিক প্রলাপের কথা।
কে ছিলেন এই নারী? মহামতি সক্রেটিসেরও (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯) ১৪০ বছর আগের, মহাকবি হোমারের খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতক ছোঁয়া—অর্থাৎ আজ থেকে ২৮০০ বছর আগের জীবনধারিণী? নানাবিধ বিষয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারিণী? কী তাঁর পরিচয়?
তিনি ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের গ্রিসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লেসবস দ্বীপবাসিনী। বিত্তবান সারকাইলাসের স্ত্রী সাফো জীবনের যাপনে, চলনে-বলনে ছিলেন জনৈকা সম্ভ্রান্ত ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’। তাই তিনি চলতে পারতেন যেমন খুশি তেমনি। ছিলেন সহজাত গীতিকবি এবং নিবেদিতচিত্ত শিক্ষয়িত্রী। পরিচালনা করতেন লেসবসের প্রধান শহর মিটিলিনে নিজের প্রতিষ্ঠা করা, অবিবাহিতা মেয়েদের একাডেমি।
তাঁর ছাত্রী হিসেবে দূর দূর থেকে আসা কুমারীদের সঙ্গে কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা ছাড়াও নিত্য মিথস্ক্রিয়াতেই কাটত সাফোর প্রতিটি দিন। (এঁর আদলেই তো সক্রেটিসের দিন কাটত ছেলেদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াতে? এ ব্যাপারে সাফোর ভাবশিষ্যও তো ভাবা যায় সক্রেটিসকে!)।
‘আনওয়েড’ ছাত্রীদের সঙ্গে এই শিক্ষিকার অন্তরঙ্গতা এতখানি বেড়ে যেত যে বিদায়কালে প্রত্যেককেই একটি করে ‘ওয়েডিং সং’ লিখে দিতেন সাফো। গানগুলোর কাব্যভাষা হতো ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশে খোলামেলা, যেমন:
Please
Come back to me, Gongyla, here tonight,
You, my rose, with your Lydian lyre.
There hovers forever around you delight :
A beauty desired.
...
—Translated by Paul Roche
হোমারের মতো দেবতাকে সম্বোধন নয়, মহাকাব্যিক বয়ানও নয়; সাফোর কবিতায় ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির কথা, ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বারতা—সবই ব্যক্তিগত প্রেমবিষয়ক। গীতিকবিতার ইতিহাসে এটা প্রথম ঘটে সাফোর লিরিকেই। তিনি গান লিখতেন এবং সুর দিতেন ‘লায়ার’ বা বীণা বাজিয়ে সোলো গাওয়ার জন্য। গীতিকবিতার Lyric নামকরণ হয় সাফোর Lyre থেকেই। লিরিকের জন্য নিজস্ব একটি ছন্দও উদ্ভাবন করেছেন এই কালজয়ী লিরিসিস্ট, যেটি ‘সাফিক মিটার’ নামে প্রচলনে এসে অব্যবহিত পরবর্তী গীতিকবিদের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলনয়না রূপসী সাফোর দৃষ্টান্তেই ‘নীলকান্তমণি’ নামী প্রেশাস স্টোনের নামকরণ হয় Sapphire।
সাফো তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তী দুই শ বছর সাফার করেন সমকামিতার রটনায়। তবু খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতকে তাঁর নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রথম কারণ হোমারিক ও অ্যাট্টিক গ্রিক ভাষার উত্থান ও জটিল ইয়োলিয়ান (লেসবিয়ান) আঞ্চলিক ভাষার পতন—যে আঞ্চলিক সুরেলা ভাষায় সাফো গান লিখতেন। তাঁর কাব্যভাষা ছিল আন্তরিক আঞ্চলিক, আনুষ্ঠানিক সাহিত্যিক নয়।
দ্বিতীয় কারণ, কবি অ্যানাক্রিয়ন কর্তৃক আনীত সমকামিতার অভিযোগে তাইতিয়ান নামক চার্চম্যানের আদেশে ১৪১ খ্রিষ্টাব্দে সাফোর পাণ্ডুলিপি ধ্বংসকরণ। তেমনি ‘কামোদ্দীপক’ জ্ঞান করে সাফোর ভক্তদের স্মৃতিবাহিত বাকি কবিতাগুলোও ১০৭৩ সালে পোপ গ্রেগরির নির্দেশে দাহন।
আবার তার অনেকখানি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় অক্সিরাইনচুস-স্তূপের প্রাচীন রাবিশের মধ্যে পাওয়া ইজিপ্সিয়ান প্যাপিরাসের টুকরাটাকরা থেকে, ১৮৯৮ সালে। এই উনিশ শতকেই নারীসমাজের সমকামিতার পরিভাষা হিসেবে সমগ্র বিশ্বের নিয়মিত ব্যবহারে চলে আসে Lesbian ও Sapphic শব্দ দুটি এবং স্থায়ীভাবে। এর অন্যতম কারণ ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসের পর থেকে সাফোর আদৃতি ও উদ্ধৃতি দিন দিন বেড়ে চলা।
সাফোর আদৃতির বহরটা ইতিহাসজুড়েই দেখুন। প্লেটো তাঁর অ্যান্থলজিয়া প্যালাটিনার এক এপিগ্রামে বলেছেন:
Some say the Muses are nine : how careless!
Look, there’s Sappho too, from Lesbos, the tenth.
এথেন্সের শাসক ও কবি সোলন (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩৮-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৮) সাফোর একটা গান শুনে বলেছেন এটা আমাকে শেখাও। কারণ I want to learn it and die। রোমান কবি কাতুল্লুস (খ্রিষ্টপূর্ব ৮৪-৫৪) সাফোর গান অনুবাদ করেছেন জাঁকজমকের সঙ্গে। মার্কিন কবি ও লেখিকা গার্টুড স্টিন সাফোর স্বকাল থেকে অনেক অগ্রসর ‘ও মুন’, ‘ও সি’, ‘ও লাভ’ সম্বোধিত কবিতা পড়ে মুগ্ধবিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছেন: এপিক কবি হোমারের ‘রোজি ফিঙ্গার্স’ থাকে বীর্যের প্রতীক সূর্যোদয়ের সঙ্গে, আর লিরিক কবি সাফোর ‘রোজি ফিঙ্গার্স’ থাকে প্রেমের প্রতীক চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে—সাফোর কাব্যের বাতাসে প্রেম এমনি সতত ভাসে।
সাফোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা, এমনকি তাঁকে সিসিলিতে নির্বাসিত করা; এসবের মূল কারণ—তিনি ছিলেন তাঁর কাল থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। তাঁর ‘সিঙ্গল উইমেনস অ্যাকাডেমি’ একাই যথেষ্ট ছিল সমাজকে খেপানোর জন্য। যেমন একালের রবীন্দ্র-বিদূষণের প্রধান কারণও ছিল তাঁর স্বকাল থেকে বেজায় বেশি এগিয়ে থাকা—যথা ভদ্র ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের নৃত্যশিল্পীরূপে মঞ্চস্থ করা।
তা ছাড়া গোলাপপ্রেমী সাফো যে বৈকৃতকাম ছিলেন না, তার চূড়ান্ত প্রমাণ হলো তাঁর বিবাহ ও সন্তান জনন। লেসবিয়ান নারী যেখানে পুরুষকে অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে ঘনিষ্ঠ হতে দেন না—সেখানে পুরুষের ঔরসে তাঁর গর্ভে সন্তান ধারণ করার কথা ভাবাও যায় না। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অষ্টম খণ্ড মাইক্রোপিডিয়া লিখেছে—এটা নিশ্চিত যে সাফো এক কন্যাসন্তানের জননী হয়েছিলেন। কন্যাটির নাম রেখেছিলেন নিজের মায়ের নামে, ক্লিস।
এ ছাড়া ল্যাটিন কবি ওভিদ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩-খ্রিষ্ট ১৮) বর্ণিত লেজেন্ডে আছে—ফাওন নামের এক তরুণ নাবিক কর্তৃক প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে সাফো সমুদ্র-তীরবর্তী অতি উচ্চ এক পর্বতগাত্র থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পুরুষের জন্য কোনো সমকামী নারীর আত্মহত্যা করা অকল্পনীয়।
আমি প্রাণবন্ত এই কালজয়ী গীতিকবির কামবিকৃতির সত্যমিথ্যা গল্পগাছা শুনতেও প্রস্তুত নই। কারণ, তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে গোলাপের দেশটা আমার দেখা হতো না, তিনি দেখিয়ে না দিলে গোলাপের পথে আমার চলা হতো না। স্বতন্ত্র শ্রেণীর গানের স্রষ্টা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় হয়তো সাফো আর গোলাপকে মনে রেখেই এই অবিস্মরণীয় গানটির কথা আর সুর রচনা করেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা না হলে/ ভালোবাসার দেশটা আমার দেখা হতো না/ তুমি না হাত বাড়িয়ে দিলে/ এমন একটি পথে আমার চলা হতো না’/।
আনীত অভিযোগ সমকামিতার চিহ্নমাত্র দ্রষ্টব্য নয়, তাঁর অবিনষ্ট কবিতানিচয়ের কোথাও। তবু ইউরোপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠা নারী গীতিকবি লেসবসের সাফোকেই সমকামী নারীর প্রোটোটাইপ বা আদিরূপ জ্ঞান করে নারীসমাজের সমকামিতার জাত্যর্থরূপে সর্বকালের জন্যই স্থায়ী হয়ে গেল ‘সাফিফজম’ বা ‘লেসবিয়ানিজম’ শব্দদ্বয়। অসত্য এভাবেই ইতিহাসের ঘাড়ে চেপে বেঁচে থাকে কাল থেকে কালে।
এবারে প্রথম প্রশ্নটির জবাব দেওয়া যাক। এককালের এশিয়া মাইনরের অংশ, লেসবস দ্বীপে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সাফো দেখেছিলেন পাঁচ-পাপড়ির সহজ সরল বিনম্র সুন্দর প্রাকৃতিক গোলাপ, যে আপন খেয়ালে নিজে নিজে ফোটে—কি অরণ্যে কি উদ্যানে। যাকে ব্রিড করে কেউ ফোটায় না। বন্য অভিহিত এই গোলাপ প্রাকৃতিক উদ্ভিদবিশ্বের সুন্দরতম অংশটি। এর বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক নাম স্পিশিজ রোজ।
কেউ ফোটায় না বলেই বর্তমান বিশ্বে ওয়াইল্ড বা স্পিশিজ-রোজের টাইপ মাত্র ১০০, যেখানে ব্রিড-রোজের ভ্যারাইটি প্রায় তিন হাজার। আদিম গোলাপের পাপড়ির সংখ্যা সর্বোর্ধ্ব পাঁচ, কদাচিৎ চারও দেখা যায়। কিন্তু পাঁচের বেশি দেখলেই বুঝতে হবে ওটা নির্ভেজাল আদিম নয়, কৃত্রিম বা ব্রিড গোলাপ। মাত্র পাঁচটি পাপড়ি অনুভূমিক থাকে বলে প্রতিটি পাপড়ির পূর্ণ রূপ একনজরে দর্শন ও রসাস্বাদন সম্ভব হয় একমাত্র এই বন্য গোলাপেই।
সাফো এই ন্যাচারেল স্পিশিজ রোজ বা প্রাকৃতিক বুনো গোলাপ ছাড়া কোনো কালচার্ড বা কাল্টিভার রোজ দেখেননি। কারণ, রোজ-কালচারের সূচনাই হয় সাফোর কাল থেকে দেড় হাজার বছর পরে, সেও তাঁর দেশ থেকে বহু হাজার মাইল দূরে—দূরপ্রাচ্যের সুদূর চীনদেশে। তাঁর উপমহাদেশ ইউরোপে কাল্টিভার রোজ বা বর্ণ-সংকর গোলাপের চর্চা শুরু হয় সাফোর সময়ের আড়াই হাজার বছর পরে।
জাপানি উদ্ভিদবিদ মিকিনোরি ওগিসু তাঁর ‘মাই ওয়ার্ল্ড অব প্লান্টস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন: চীনদেশের জনগণ প্রাচীন গোলাপের সংকরায়ণ-পদ্ধতি শিখে কাল্টিভার বা আধুনিক গোলাপের উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে আসছেন হাজার বছর আগে থেকে, যেখানে ইউরোপ-আমেরিকায় কাল্টিভার রোজের ইতিহাসের বয়স মাত্র শ-দুয়েক বছর।
প্রতিটি রাজবংশেই চৈনিক বিবুধম-লি মনমাতানো সৌরভময় প্রাকৃতিক গোলাপের সৌন্দর্যে আবিষ্ট ছিলেন। কাব্যে কেবল গোলাপেরই গান গাইতেন তাঁরা। আজ সেসব কবিতা পড়েই আমরা বুঝতে পারি সেকালের জনগণ কেমন বিমোহিত ছিলেন অনাড়ম্বর প্রাকৃতিক গোলাপের মনোহর পারিপাট্য দেখে। সং বংশের রাজত্বকালের (৯৬০-১২৭৯) মহৎ কবি চেন কানজেং কর্তৃক আদিম গোলাপ উৎকীর্তিত হয়েছে বিশ্বের সমস্ত পুষ্পের চেয়ে বেশি রোমান্টিক বলে। উত্তর চীনের সং ডিনেস্টিতে গোলাপের সম্মানে অন্যান্য অনেক স্বনামধন্য উদ্ভিদকেই অনেক জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে।
চীনের জিয়াংসু প্রদেশের ফরেস্ট্রি অ্যাকাডেমির প্রফেসর ওয়াং গুয়োলিয়াং তাঁর ত্রিশ বছরের গবেষণার ফসল ‘হাজার বছর আগের চায়নিজ সং ডিনেস্টির প্রাচীন গোলাপ’ শীর্ষক একটি মিমিয়োগ্রাফে বলেছেন যে চীনের প্রাকৃতিক গোলাপের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য এখনো তাঁকে স্তম্ভিত করে। মিমিয়োগ্রাফটিতে তিনি চীনের শাংরি-লা ডিস্ট্রিক্টের আদিম গোলাপ আর রোজ কাল্টিভেশনের সুদীর্ঘ ইতিহাসসমৃদ্ধ প্রাচীন গোলাপের কিছু নির্বাচিত ভ্যারাইটি নিয়ে চাঞ্চল্যকর আলোচনা করেন।
আলোচনার ফোরামটি ছিল ম্যানহাটন রোজ সোসাইটি কর্তৃক এই ‘প্রাকৃতিক গোলাপ’ বিশেষজ্ঞের সম্মানে আয়োজিত ‘ডিনার উইথ ডক্টর ওয়াং গুয়োলিয়াং’। এই ইভেন্ট থেকেই আমি জানলাম: গোলাপবিশ্বের প্রবীণ ও নবীন দুই নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক গোলাপের প্রতি এখনো কত গভীরভাবে উৎসাহী। জানলাম ‘ম্যানহাটন রোজ সোসাইটি’র ‘স্কাইস্ক্রেপার্স অ্যান্ড রোজেস’ নামক নিউজলেটারে প্রকাশিত ইভেন্টটির ওপর দীর্ঘ প্রতিবেদন থেকে।
ভেবে বিস্মিত হলাম যে যুক্তরাষ্ট্র গোলাপ বানানোতেও বোমা বানানোর মতোই পারদর্শী। এ কারণেই বাকি বিশ্ব কর্তৃক উদ্ভাবিত গোলাপের নিবন্ধনও করতে হয় ‘আমেরিকান রোজ সোসাইটি’ কর্তৃক প্রবর্তিত ও পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল চেকলিস্টে। প্রযুক্তির প্রতীক স্কাইস্ক্রেপার্সের সঙ্গে প্রকৃতির প্রতীক গোলাপের এই মেলবন্ধন সর্বগ্রাসী বিভ্রান্তির চলমান এই কালটিতে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।
কদাচিৎ সাদা দেখা গেলেও বন্য গোলাপ সাধারণত গোলাপি রঙেরই হয়। বরং ‘গোলাপি রং’ কথাটি সাফো বর্ণিত সেই প্রাকৃতিক গোলাপেরই সৃষ্টি। যেকোনো মিশ্র রঙে গোলাপি আভা বর্ণনাটাও আদিম গোলাপেরই অবদান, যেমন গোলাপি লাল, গোলাপি বেগনি।
এই না-শুঁকে পাওয়ার মতো সুরভি-বিলানো প্রাকৃতিক গোলাপ আজ সবার বাগান থেকেই নির্বাসিত। অথচ ওয়াইল্ড রোজ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সব বড় মহাদেশেরই নেটিভ। এশিয়া-ইউরোপের সহজাত গোলাপগুলোর কথা আমার গোলাপসংগ্রহ গ্রন্থে সবিস্তারে বলা হয়েছে। এখানে তাই শুধু আমেরিকার কিছু প্রাকৃতিক গোলাপের উল্লেখ করছি।
যেমন—ইস্ট কোস্টের রোজা ক্যারোলাইনা, রোজা পালুস্ট্রিস বা সোয়াম্প রোজ (ক্যারোলাইনার মতো এটাও শ্রাবরোজ), রোজা আরকানসানা বা প্রেইরি রোজ (মধ্য-যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়), রোজা ভার্জিনিয়ানা বা ভার্জিনিয়া রোজ, রোজা উডসি বা উডস ওয়াইল্ড রোজ (রকি মাউন্টেন রোজ), রোজা নুটকানা বা নুটকা রোজ (প্যাসিফিক কোস্টের আলাস্কা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত)।
একই মৌসুমে বারবার ফোটার আধুনিক গোলাপ উদ্ভাবনের পর বাগানে প্রাকৃতিক গোলাপের জনপ্রিয়তা হ্রাসের এক কারণ তো এর বছরে কেবল একটিবার ফোটা, তাও মাত্র দুসপ্তাহের জন্য।
কিন্তু প্রাকৃতিক গোলাপের নিরিবিলি সৌন্দর্য তো অবিকল্প। মনে মনে পাঁচ-পাপড়িবিশিষ্ট সিঙ্গলরোজ ‘ইলেন উইলমট’ অথবা ‘অল্টিসিমো’র নীরব সৌন্দর্যের সঙ্গে ১০০+ পাপড়িসংবলিত হাইব্রিড-টি রোজ ‘বেলিন্ডাজ ড্রিম’ বা ‘কোয়ায়েটনেস’-এর সরব ঐশ্বর্যের পার্থক্যটা পরখ করে বুঝে নিন।
উদ্যানের ল্যান্ডস্কেপশিল্পীগণ তাই এশিয়ার জাপান-কোরিয়া-চায়নার ওয়াইল্ড রোজ রুগোসার সঙ্গে ক্রসব্রিডিঙের মাধ্যমে সিঙ্গল-ব্লুমিং বন্য গোলাপকে রিপিট-ব্লুমিং রোজ বানানোর চেষ্টায় কিছুটা সাফল্য অর্জন করে সুন্দর একটি ভিন্ন রূপের গোলাপ পেয়ে যথাযোগ্য নাম দিয়েছেন ‘নিয়ারলি ওয়াইল্ড রোজ’।
তথ্য সুত্র: প্রথম আলো, তারিখ: ২৩-১২-২০১১
প্রথমে গোলাপের লিখিত ইতিহাসটা একনজর দেখা যাক। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তবিংশতি শতকী সারগনের আমলের রাজসমাধিভূমে স্যার লেনার্ড উলির প্রাচীনতম আবিষ্কার-পরবর্তী বেশ কটি শতাব্দীই পুষ্পরানির দলিলবিহীন। তবে ধরে নেওয়া চলে যে ইরাকি-তুর্কি মাতৃভূমি থেকে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে তার জয়যাত্রা শুরু করে জলে-স্থলে বাণিজ্যপথ ধরে উদ্যমী পুষ্পটি পৌঁছে গিয়েছিল ক্রিটে, গ্রিসে, আফ্রিকার উত্তরে, মিসরে—সওদাগরি কারোয়ানের সখের সঙ্গিনী হয়ে। এমনি করে হাজার বছর ধরে অলখে লুকিয়ে থাকার পরে অবশেষে গোলাপের দেখা মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ষোলো শতকের ক্রিটের দেয়ালচিত্রে আর মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবিতে।
খ্রিষ্টের সাত শ বছর আগের মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিসির দুটিতেই গোলাপের উল্লেখ রয়েছে, তবে বিশেষ গোলাপের নয়, গোলাপবিশেষের। শৈলীগত বাগ্ভঙ্গিমায়—যেমন ‘দ্য রোজি ফিঙ্গারড ডন’। হোমারের বর্ণনায় অ্যাকিলিসের ঢাল ছিল গোলাপখচিত, নিহত হেক্টরের সর্বাঙ্গে আফ্রোদিতি লেপন করেছিলেন গোলাপেরই মলম। প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি এবং রোমান দেবী ভিনাস—উভয়ের প্রতি উৎসর্গিত পুষ্পটি ছিল বিকল্পহীন গোলাপ। গ্রিসের স্মির্নাবাসী হোমারের গোলাপগুলো ছিল অবশ্যই সাদামাটা প্রাকৃতিক গোলাপ।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে গ্রিসের লেসবসবাসিনী গীতিকবি সাফোর (খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০-৫৮০) বাণীবন্দনাতেই পুষ্পকুলের রানিরূপে প্রথম অধিষ্ঠান গোলাপের। সেই থেকে, বিগত ২৭০০+ বছরের ইতিহাসে, এই পৃথিবীতে গোলাপই একমাত্র রাজন্য যিনি তাঁর রাজমুকুটখানি হারাননি—বরং সাম্রাজ্যটিও নিরবধিই বিস্তার করে চলেছেন।
লেসবসের এই কালজয়ী গীতিকবির যে গানে গোলাপের পুষ্পরানি হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল সেটির উদ্ধৃতি দেওয়া গেল সরাসরি গ্রিক থেকে ইংরেজি অনুবাদে:
Song of Rose
‘Would Jove appoint some flower to reign,
In matchless beauty on the plain,
The Rose (mankind will all agree),
The rose the queen of flowers should be;...
(Translation : F. Fawkes)
পরবর্তীকালের কবি, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের অ্যানাক্রিয়নের স্তবগানে গোলাপের ধরাধামে আবির্ভাব বর্ণিত হয়েছে সবিস্তারে—যেমন কীভাবে প্রেমদেবী আফ্রোদিতির সমুদ্র থেকে অভ্যুত্থানের অভিঘাতপ্রসূত শুভ্র সমুদ্রফেনা থেকে অভ্যুদয় ঘটেছিল তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি গোলাপের। এ কবির গোলাপও ছিল প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক মূল্য সংযোজিত নয়।
গোলাপকে ‘পুষ্পরানি’র সিংহাসনে অভিষিক্তকারিণী সাফোর এ গান যতবার পড়ি ততবারই ভালো লাগে এবং ততবারই প্রশ্ন জাগে: কী গোলাপ দেখে সুপ্রাচীন এই গ্রিক কবি এমন উচ্ছ্বসিত গোলাপ-প্রশস্তি লিখে ফুলের সিংহাসনে গোলাপকে চিরস্থায়ী করলেন এবং নিজেও গোলাপের মতোই নিত্য উদ্ধৃত রইলেন? তাঁর দেশ ও কালের খ্যাতিমান অন্য কবি কি সে গোলাপ দেখেননি? যেমন তাঁর সমসাময়িক কবি আলসিউস? যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন সমকালীন রাজনৈতিক ডামাডোল নিয়ে লিখে?
আগে দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব দেওয়া যাক। আসলে যার যা দেখার তিনি তা-ই দেখেছেন। রোমান্টিক প্রকৃতির ইন্দ্রিয়সেবী গীতিকবি সাফো মানুষের দলাদলির বদলে গোলাপের ঢলাঢলি দেখেছেন। যেমন দেখেছেন পারস্য কবি ওমর খৈয়াম (খ্রিষ্ট ১০৪৮-১১৩১)। তিনিও গোলাপ নিয়ে মাতামাতি করেছেন সরল সৌন্দর্যের প্রতীক প্রাকৃতিক গোলাপ দেখে।
জটিল সৌন্দর্যের গোলাপ নিয়ে প্রথম কাব্য রচনা করেছেন সম্ভবত চীন দেশের সং বংশের রাজত্বকালের (৯৬০-১২৭৯) কবিকুল, যাঁদের দেশে তাঁদের কালের আগে থেকেই প্রকৃতির কাজে হাত লাগিয়ে সংকর-প্রজনকগণ সিঙ্গেল গোলাপের বহুগুণ বেশি পাপড়িসংবলিত একালের সেমিডাবল, ডাবল, ফুল, ভেরি ফুল ইত্যাদি সংজ্ঞায়িত গোলাপের জটিল সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।
ওমর খৈয়ামের কবিতাকে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন ফুলের মতো ফুটে ওঠা দর্শন, যেমন হালকা, যেমন ফুরফুরে, তেমনি সুন্দর, তেমনি রঙিন:
‘এর প্রতিটি হচ্ছে ইরানদেশের গোলাপ,—এ গোলাপের রঙের সম্বন্ধে ওমর জিজ্ঞাসা করেছেন, “দীর্ণ-হিয়া কোন সে রাজার/ রক্তে নাওয়া এই গোলাপ—/ কার দেওয়া সে লালচে আভা,/ হূদয়-ছ্যাঁচা শোণিত-ছাপ’। ওমরের কবিতার রস ফুলের আসব, সে রস পান করলে মানুষের মনে গোলাপি নেশা ধরে...।’
যেমন কান্তি ঘোষের অনুবাদে:
সদ্য ফোটা এই যে গোলাপ, গন্ধ-প্রীতি-উজল মুখ,
বলছে না কি—মিথ্যা এসব, এই ক্ষণিকের দুঃখ সুখ।
পৃথ্বী-বুকে উঠছে ফুটে গর্্বে পরি রঙিন সাজ—
—পাপড়ি টুটে ছড়িয়ে মোদের জীবন-রেণু পথের মাঝ।
ঐহিক প্রেমী ওমরের (যিনি বলেন ‘নগদ যা’ পাও হাত পেতে নাও,/ বাকির খাতায় শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে?/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক) নগদ চাহিদার তালিকায় গোলাপের বাইরে আছে শুধু একটি দিওয়ান, মানে একটি কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যও আমার মতে কেবল একটি শৈলীর, তথা গজল নামক গীতিকবিতার—যা সুর সহযোগে শ্রাব্য।
উল্লেখযোগ্য গজল রচনার সূচনা বস্তুত জ্যোতির্বিদ কবি এই ওমর খৈয়াম থেকেই। আজ পর্যন্তও ফারসি কাব্যের শ্রেষ্ঠতম ফসল গজল। বলা হয়, ‘পারস্য হয়ে ভারতবর্ষে আগত মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম উপহার তাজমহলের পরে গজল।’
আসল কথা কাব্যজগতের ঐহিক প্রেমের একমাত্র ঘরানা গজলই মেলে পুষ্পভুবনের জাগতিক প্রেমের একমাত্র সখী গোলাপের সঙ্গে। গজলের প্রতিটি দ্বিপদী সার্বভৌম একটি শব্দার্থগত সত্তা, একটা আলাদা কবিতা। তেমনি প্রতিটি গোলাপও যেন স্বতন্ত্র একটি নন্দনতত্ত্বগত সত্তা, জনৈকা অন্যরূপা নায়িকা।
এ জন্য আমার মনে হয়—প্রতিটি গোলাপ যেন একটি গান। আবার প্রতিটি গানই যেন একটি গোলাপ। পুষ্পের ভুবনে যেমন কেবল গোলাপই দৈহিক প্রেমের অবিমিশ্র প্রেরণা, কাব্যের জগতেও তেমনি কেবল গজলই শরীরী প্রেমের অবিমিশ্র অভিব্যক্তি—তবে কেবল অপুরস্কৃত প্রেমের। কিন্তু যত পুরস্কারহীনতার হাহাকারই হোক না কেন গজল, তার কাঙ্ক্ষিত প্রতিদান অবশ্য ইন্দ্রিয়জ বাসনারই। গোলাপও এমনি ইন্দ্রিয়জ বাসনারই প্রতীক।
তেমনি ইন্দ্রিয়জ কামনার প্রতিমূর্তি গীতিকবি সাফোই তো হবেন গোলাপের সমঝদার, গাইবেন গোলাপের গান। যেমন তাঁর রাজনৈতিক গোলযোগপূর্ণ কালের অন্য কবি লিখেছেন রাজনৈতিক প্রলাপের কথা।
কে ছিলেন এই নারী? মহামতি সক্রেটিসেরও (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯) ১৪০ বছর আগের, মহাকবি হোমারের খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতক ছোঁয়া—অর্থাৎ আজ থেকে ২৮০০ বছর আগের জীবনধারিণী? নানাবিধ বিষয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারিণী? কী তাঁর পরিচয়?
তিনি ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের গ্রিসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লেসবস দ্বীপবাসিনী। বিত্তবান সারকাইলাসের স্ত্রী সাফো জীবনের যাপনে, চলনে-বলনে ছিলেন জনৈকা সম্ভ্রান্ত ‘অ্যারিস্টোক্র্যাট’। তাই তিনি চলতে পারতেন যেমন খুশি তেমনি। ছিলেন সহজাত গীতিকবি এবং নিবেদিতচিত্ত শিক্ষয়িত্রী। পরিচালনা করতেন লেসবসের প্রধান শহর মিটিলিনে নিজের প্রতিষ্ঠা করা, অবিবাহিতা মেয়েদের একাডেমি।
তাঁর ছাত্রী হিসেবে দূর দূর থেকে আসা কুমারীদের সঙ্গে কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা ছাড়াও নিত্য মিথস্ক্রিয়াতেই কাটত সাফোর প্রতিটি দিন। (এঁর আদলেই তো সক্রেটিসের দিন কাটত ছেলেদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াতে? এ ব্যাপারে সাফোর ভাবশিষ্যও তো ভাবা যায় সক্রেটিসকে!)।
‘আনওয়েড’ ছাত্রীদের সঙ্গে এই শিক্ষিকার অন্তরঙ্গতা এতখানি বেড়ে যেত যে বিদায়কালে প্রত্যেককেই একটি করে ‘ওয়েডিং সং’ লিখে দিতেন সাফো। গানগুলোর কাব্যভাষা হতো ব্যক্তিগত আবেগ প্রকাশে খোলামেলা, যেমন:
Please
Come back to me, Gongyla, here tonight,
You, my rose, with your Lydian lyre.
There hovers forever around you delight :
A beauty desired.
...
—Translated by Paul Roche
হোমারের মতো দেবতাকে সম্বোধন নয়, মহাকাব্যিক বয়ানও নয়; সাফোর কবিতায় ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির কথা, ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বারতা—সবই ব্যক্তিগত প্রেমবিষয়ক। গীতিকবিতার ইতিহাসে এটা প্রথম ঘটে সাফোর লিরিকেই। তিনি গান লিখতেন এবং সুর দিতেন ‘লায়ার’ বা বীণা বাজিয়ে সোলো গাওয়ার জন্য। গীতিকবিতার Lyric নামকরণ হয় সাফোর Lyre থেকেই। লিরিকের জন্য নিজস্ব একটি ছন্দও উদ্ভাবন করেছেন এই কালজয়ী লিরিসিস্ট, যেটি ‘সাফিক মিটার’ নামে প্রচলনে এসে অব্যবহিত পরবর্তী গীতিকবিদের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলনয়না রূপসী সাফোর দৃষ্টান্তেই ‘নীলকান্তমণি’ নামী প্রেশাস স্টোনের নামকরণ হয় Sapphire।
সাফো তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তী দুই শ বছর সাফার করেন সমকামিতার রটনায়। তবু খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতকে তাঁর নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রথম কারণ হোমারিক ও অ্যাট্টিক গ্রিক ভাষার উত্থান ও জটিল ইয়োলিয়ান (লেসবিয়ান) আঞ্চলিক ভাষার পতন—যে আঞ্চলিক সুরেলা ভাষায় সাফো গান লিখতেন। তাঁর কাব্যভাষা ছিল আন্তরিক আঞ্চলিক, আনুষ্ঠানিক সাহিত্যিক নয়।
দ্বিতীয় কারণ, কবি অ্যানাক্রিয়ন কর্তৃক আনীত সমকামিতার অভিযোগে তাইতিয়ান নামক চার্চম্যানের আদেশে ১৪১ খ্রিষ্টাব্দে সাফোর পাণ্ডুলিপি ধ্বংসকরণ। তেমনি ‘কামোদ্দীপক’ জ্ঞান করে সাফোর ভক্তদের স্মৃতিবাহিত বাকি কবিতাগুলোও ১০৭৩ সালে পোপ গ্রেগরির নির্দেশে দাহন।
আবার তার অনেকখানি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় অক্সিরাইনচুস-স্তূপের প্রাচীন রাবিশের মধ্যে পাওয়া ইজিপ্সিয়ান প্যাপিরাসের টুকরাটাকরা থেকে, ১৮৯৮ সালে। এই উনিশ শতকেই নারীসমাজের সমকামিতার পরিভাষা হিসেবে সমগ্র বিশ্বের নিয়মিত ব্যবহারে চলে আসে Lesbian ও Sapphic শব্দ দুটি এবং স্থায়ীভাবে। এর অন্যতম কারণ ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসের পর থেকে সাফোর আদৃতি ও উদ্ধৃতি দিন দিন বেড়ে চলা।
সাফোর আদৃতির বহরটা ইতিহাসজুড়েই দেখুন। প্লেটো তাঁর অ্যান্থলজিয়া প্যালাটিনার এক এপিগ্রামে বলেছেন:
Some say the Muses are nine : how careless!
Look, there’s Sappho too, from Lesbos, the tenth.
এথেন্সের শাসক ও কবি সোলন (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩৮-খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৮) সাফোর একটা গান শুনে বলেছেন এটা আমাকে শেখাও। কারণ I want to learn it and die। রোমান কবি কাতুল্লুস (খ্রিষ্টপূর্ব ৮৪-৫৪) সাফোর গান অনুবাদ করেছেন জাঁকজমকের সঙ্গে। মার্কিন কবি ও লেখিকা গার্টুড স্টিন সাফোর স্বকাল থেকে অনেক অগ্রসর ‘ও মুন’, ‘ও সি’, ‘ও লাভ’ সম্বোধিত কবিতা পড়ে মুগ্ধবিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছেন: এপিক কবি হোমারের ‘রোজি ফিঙ্গার্স’ থাকে বীর্যের প্রতীক সূর্যোদয়ের সঙ্গে, আর লিরিক কবি সাফোর ‘রোজি ফিঙ্গার্স’ থাকে প্রেমের প্রতীক চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে—সাফোর কাব্যের বাতাসে প্রেম এমনি সতত ভাসে।
সাফোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা, এমনকি তাঁকে সিসিলিতে নির্বাসিত করা; এসবের মূল কারণ—তিনি ছিলেন তাঁর কাল থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। তাঁর ‘সিঙ্গল উইমেনস অ্যাকাডেমি’ একাই যথেষ্ট ছিল সমাজকে খেপানোর জন্য। যেমন একালের রবীন্দ্র-বিদূষণের প্রধান কারণও ছিল তাঁর স্বকাল থেকে বেজায় বেশি এগিয়ে থাকা—যথা ভদ্র ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের নৃত্যশিল্পীরূপে মঞ্চস্থ করা।
তা ছাড়া গোলাপপ্রেমী সাফো যে বৈকৃতকাম ছিলেন না, তার চূড়ান্ত প্রমাণ হলো তাঁর বিবাহ ও সন্তান জনন। লেসবিয়ান নারী যেখানে পুরুষকে অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে ঘনিষ্ঠ হতে দেন না—সেখানে পুরুষের ঔরসে তাঁর গর্ভে সন্তান ধারণ করার কথা ভাবাও যায় না। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অষ্টম খণ্ড মাইক্রোপিডিয়া লিখেছে—এটা নিশ্চিত যে সাফো এক কন্যাসন্তানের জননী হয়েছিলেন। কন্যাটির নাম রেখেছিলেন নিজের মায়ের নামে, ক্লিস।
এ ছাড়া ল্যাটিন কবি ওভিদ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩-খ্রিষ্ট ১৮) বর্ণিত লেজেন্ডে আছে—ফাওন নামের এক তরুণ নাবিক কর্তৃক প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে সাফো সমুদ্র-তীরবর্তী অতি উচ্চ এক পর্বতগাত্র থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। পুরুষের জন্য কোনো সমকামী নারীর আত্মহত্যা করা অকল্পনীয়।
আমি প্রাণবন্ত এই কালজয়ী গীতিকবির কামবিকৃতির সত্যমিথ্যা গল্পগাছা শুনতেও প্রস্তুত নই। কারণ, তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে গোলাপের দেশটা আমার দেখা হতো না, তিনি দেখিয়ে না দিলে গোলাপের পথে আমার চলা হতো না। স্বতন্ত্র শ্রেণীর গানের স্রষ্টা জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় হয়তো সাফো আর গোলাপকে মনে রেখেই এই অবিস্মরণীয় গানটির কথা আর সুর রচনা করেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা না হলে/ ভালোবাসার দেশটা আমার দেখা হতো না/ তুমি না হাত বাড়িয়ে দিলে/ এমন একটি পথে আমার চলা হতো না’/।
আনীত অভিযোগ সমকামিতার চিহ্নমাত্র দ্রষ্টব্য নয়, তাঁর অবিনষ্ট কবিতানিচয়ের কোথাও। তবু ইউরোপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠা নারী গীতিকবি লেসবসের সাফোকেই সমকামী নারীর প্রোটোটাইপ বা আদিরূপ জ্ঞান করে নারীসমাজের সমকামিতার জাত্যর্থরূপে সর্বকালের জন্যই স্থায়ী হয়ে গেল ‘সাফিফজম’ বা ‘লেসবিয়ানিজম’ শব্দদ্বয়। অসত্য এভাবেই ইতিহাসের ঘাড়ে চেপে বেঁচে থাকে কাল থেকে কালে।
এবারে প্রথম প্রশ্নটির জবাব দেওয়া যাক। এককালের এশিয়া মাইনরের অংশ, লেসবস দ্বীপে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সাফো দেখেছিলেন পাঁচ-পাপড়ির সহজ সরল বিনম্র সুন্দর প্রাকৃতিক গোলাপ, যে আপন খেয়ালে নিজে নিজে ফোটে—কি অরণ্যে কি উদ্যানে। যাকে ব্রিড করে কেউ ফোটায় না। বন্য অভিহিত এই গোলাপ প্রাকৃতিক উদ্ভিদবিশ্বের সুন্দরতম অংশটি। এর বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক নাম স্পিশিজ রোজ।
কেউ ফোটায় না বলেই বর্তমান বিশ্বে ওয়াইল্ড বা স্পিশিজ-রোজের টাইপ মাত্র ১০০, যেখানে ব্রিড-রোজের ভ্যারাইটি প্রায় তিন হাজার। আদিম গোলাপের পাপড়ির সংখ্যা সর্বোর্ধ্ব পাঁচ, কদাচিৎ চারও দেখা যায়। কিন্তু পাঁচের বেশি দেখলেই বুঝতে হবে ওটা নির্ভেজাল আদিম নয়, কৃত্রিম বা ব্রিড গোলাপ। মাত্র পাঁচটি পাপড়ি অনুভূমিক থাকে বলে প্রতিটি পাপড়ির পূর্ণ রূপ একনজরে দর্শন ও রসাস্বাদন সম্ভব হয় একমাত্র এই বন্য গোলাপেই।
সাফো এই ন্যাচারেল স্পিশিজ রোজ বা প্রাকৃতিক বুনো গোলাপ ছাড়া কোনো কালচার্ড বা কাল্টিভার রোজ দেখেননি। কারণ, রোজ-কালচারের সূচনাই হয় সাফোর কাল থেকে দেড় হাজার বছর পরে, সেও তাঁর দেশ থেকে বহু হাজার মাইল দূরে—দূরপ্রাচ্যের সুদূর চীনদেশে। তাঁর উপমহাদেশ ইউরোপে কাল্টিভার রোজ বা বর্ণ-সংকর গোলাপের চর্চা শুরু হয় সাফোর সময়ের আড়াই হাজার বছর পরে।
জাপানি উদ্ভিদবিদ মিকিনোরি ওগিসু তাঁর ‘মাই ওয়ার্ল্ড অব প্লান্টস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন: চীনদেশের জনগণ প্রাচীন গোলাপের সংকরায়ণ-পদ্ধতি শিখে কাল্টিভার বা আধুনিক গোলাপের উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে আসছেন হাজার বছর আগে থেকে, যেখানে ইউরোপ-আমেরিকায় কাল্টিভার রোজের ইতিহাসের বয়স মাত্র শ-দুয়েক বছর।
প্রতিটি রাজবংশেই চৈনিক বিবুধম-লি মনমাতানো সৌরভময় প্রাকৃতিক গোলাপের সৌন্দর্যে আবিষ্ট ছিলেন। কাব্যে কেবল গোলাপেরই গান গাইতেন তাঁরা। আজ সেসব কবিতা পড়েই আমরা বুঝতে পারি সেকালের জনগণ কেমন বিমোহিত ছিলেন অনাড়ম্বর প্রাকৃতিক গোলাপের মনোহর পারিপাট্য দেখে। সং বংশের রাজত্বকালের (৯৬০-১২৭৯) মহৎ কবি চেন কানজেং কর্তৃক আদিম গোলাপ উৎকীর্তিত হয়েছে বিশ্বের সমস্ত পুষ্পের চেয়ে বেশি রোমান্টিক বলে। উত্তর চীনের সং ডিনেস্টিতে গোলাপের সম্মানে অন্যান্য অনেক স্বনামধন্য উদ্ভিদকেই অনেক জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে।
চীনের জিয়াংসু প্রদেশের ফরেস্ট্রি অ্যাকাডেমির প্রফেসর ওয়াং গুয়োলিয়াং তাঁর ত্রিশ বছরের গবেষণার ফসল ‘হাজার বছর আগের চায়নিজ সং ডিনেস্টির প্রাচীন গোলাপ’ শীর্ষক একটি মিমিয়োগ্রাফে বলেছেন যে চীনের প্রাকৃতিক গোলাপের বৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য এখনো তাঁকে স্তম্ভিত করে। মিমিয়োগ্রাফটিতে তিনি চীনের শাংরি-লা ডিস্ট্রিক্টের আদিম গোলাপ আর রোজ কাল্টিভেশনের সুদীর্ঘ ইতিহাসসমৃদ্ধ প্রাচীন গোলাপের কিছু নির্বাচিত ভ্যারাইটি নিয়ে চাঞ্চল্যকর আলোচনা করেন।
আলোচনার ফোরামটি ছিল ম্যানহাটন রোজ সোসাইটি কর্তৃক এই ‘প্রাকৃতিক গোলাপ’ বিশেষজ্ঞের সম্মানে আয়োজিত ‘ডিনার উইথ ডক্টর ওয়াং গুয়োলিয়াং’। এই ইভেন্ট থেকেই আমি জানলাম: গোলাপবিশ্বের প্রবীণ ও নবীন দুই নেতা চীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রাকৃতিক গোলাপের প্রতি এখনো কত গভীরভাবে উৎসাহী। জানলাম ‘ম্যানহাটন রোজ সোসাইটি’র ‘স্কাইস্ক্রেপার্স অ্যান্ড রোজেস’ নামক নিউজলেটারে প্রকাশিত ইভেন্টটির ওপর দীর্ঘ প্রতিবেদন থেকে।
ভেবে বিস্মিত হলাম যে যুক্তরাষ্ট্র গোলাপ বানানোতেও বোমা বানানোর মতোই পারদর্শী। এ কারণেই বাকি বিশ্ব কর্তৃক উদ্ভাবিত গোলাপের নিবন্ধনও করতে হয় ‘আমেরিকান রোজ সোসাইটি’ কর্তৃক প্রবর্তিত ও পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল চেকলিস্টে। প্রযুক্তির প্রতীক স্কাইস্ক্রেপার্সের সঙ্গে প্রকৃতির প্রতীক গোলাপের এই মেলবন্ধন সর্বগ্রাসী বিভ্রান্তির চলমান এই কালটিতে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।
কদাচিৎ সাদা দেখা গেলেও বন্য গোলাপ সাধারণত গোলাপি রঙেরই হয়। বরং ‘গোলাপি রং’ কথাটি সাফো বর্ণিত সেই প্রাকৃতিক গোলাপেরই সৃষ্টি। যেকোনো মিশ্র রঙে গোলাপি আভা বর্ণনাটাও আদিম গোলাপেরই অবদান, যেমন গোলাপি লাল, গোলাপি বেগনি।
এই না-শুঁকে পাওয়ার মতো সুরভি-বিলানো প্রাকৃতিক গোলাপ আজ সবার বাগান থেকেই নির্বাসিত। অথচ ওয়াইল্ড রোজ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার মতো সব বড় মহাদেশেরই নেটিভ। এশিয়া-ইউরোপের সহজাত গোলাপগুলোর কথা আমার গোলাপসংগ্রহ গ্রন্থে সবিস্তারে বলা হয়েছে। এখানে তাই শুধু আমেরিকার কিছু প্রাকৃতিক গোলাপের উল্লেখ করছি।
যেমন—ইস্ট কোস্টের রোজা ক্যারোলাইনা, রোজা পালুস্ট্রিস বা সোয়াম্প রোজ (ক্যারোলাইনার মতো এটাও শ্রাবরোজ), রোজা আরকানসানা বা প্রেইরি রোজ (মধ্য-যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়), রোজা ভার্জিনিয়ানা বা ভার্জিনিয়া রোজ, রোজা উডসি বা উডস ওয়াইল্ড রোজ (রকি মাউন্টেন রোজ), রোজা নুটকানা বা নুটকা রোজ (প্যাসিফিক কোস্টের আলাস্কা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত)।
একই মৌসুমে বারবার ফোটার আধুনিক গোলাপ উদ্ভাবনের পর বাগানে প্রাকৃতিক গোলাপের জনপ্রিয়তা হ্রাসের এক কারণ তো এর বছরে কেবল একটিবার ফোটা, তাও মাত্র দুসপ্তাহের জন্য।
কিন্তু প্রাকৃতিক গোলাপের নিরিবিলি সৌন্দর্য তো অবিকল্প। মনে মনে পাঁচ-পাপড়িবিশিষ্ট সিঙ্গলরোজ ‘ইলেন উইলমট’ অথবা ‘অল্টিসিমো’র নীরব সৌন্দর্যের সঙ্গে ১০০+ পাপড়িসংবলিত হাইব্রিড-টি রোজ ‘বেলিন্ডাজ ড্রিম’ বা ‘কোয়ায়েটনেস’-এর সরব ঐশ্বর্যের পার্থক্যটা পরখ করে বুঝে নিন।
উদ্যানের ল্যান্ডস্কেপশিল্পীগণ তাই এশিয়ার জাপান-কোরিয়া-চায়নার ওয়াইল্ড রোজ রুগোসার সঙ্গে ক্রসব্রিডিঙের মাধ্যমে সিঙ্গল-ব্লুমিং বন্য গোলাপকে রিপিট-ব্লুমিং রোজ বানানোর চেষ্টায় কিছুটা সাফল্য অর্জন করে সুন্দর একটি ভিন্ন রূপের গোলাপ পেয়ে যথাযোগ্য নাম দিয়েছেন ‘নিয়ারলি ওয়াইল্ড রোজ’।
তথ্য সুত্র: প্রথম আলো, তারিখ: ২৩-১২-২০১১