শীত নেমেছে। কখনো মেঘলা, কখনো রোদ। তবে তাতে ঠাণ্ডা কিছুমাত্র কমেনি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পান বরজের ভেতর পানগাছের লতাগুলোও যেন হিম হয়ে আছে। নতুন কোনো পাতা ছাড়ছে না, লতাগুলো আড়মোড়া ভেঙে বরজের ছাউনি ছুঁতে মোটেই ব্যস্ত নয়। বরং শীতে পাতাগুলো হয়ে গেছে ছোট, হলদে ভাবও ধরেছে। কোনো কোনো বরজে এখনো রেশ রয়ে গেছে লতা আর গোড়া পচা রোগের। বরজের মধ্যে কোনো কোনো পিলির (সারি) অর্ধেক গাছ এ রোগে মরে গেছে। এক কথায় শীতে বেশ কাবু করে ফেলেছে পানগাছগুলোকে। মহেশপুরে বেশ কয়েকটি বরজে গিয়ে পানগাছের এরূপ কাহিল চিত্র চোখে পড়ল। পানচাষিরা বললেন, প্রতি বছরই শীত এলে পানের এমন দশা হয়। এটাই না কী নিয়ম। শীতের পর বসন্ত এলে গাছ এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবে, বোশেখ থেকে শুরু হবে নতুন পাতা।
কিন্তু মহেশপুর থেকে ঘুরে গিয়ে যখন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় পৌঁছলাম তখন দেখলাম ঠিক উল্টো চিত্র। কোথায় পাতা হলদে হয়ে যাওয়া শীর্ণ লতা, আর কোথায় রোগ? বরং প্রতিটি পানগাছ যেন টগবগে যুবক। ইয়া বড় বড় সবুজ পাতা, মোটা মোটা শক্ত লতা। শীতকে গাছগুলো যেন থোড়াই কেয়ার করছে। উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়নের আমবাড়িয়া গ্রামের পানচাষি মহানন্দ বিশ্বাস বললেন, তার ১৫ কাঠার একটি পানবরজ থেকে ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ, এ চার মাসে ৭০ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়েছে। শীতে পাতার উৎপাদন কম ঠিকই, কিন্তু দাম ভালো।
কিন্তু পান চাষে এই নবজাগরণের রহস্য কী? জিজ্ঞেস করতেই পানচাষি মহানন্দ বিশ্বাস বললেন, আগে রাসায়নিক সার আর নানারকম মেডিসিন দিয়ে বরজের যে সর্বনাশ করেছি এখন সে ভুল আর আমরা করছি না। পানের বরজে শুধু জৈবসার দিলেই যে এমন ভালো কাজ হয় তা কে জানত? তিনি জানান, ২০০৬ সালে তিনি এ বরজটি গড়ে তোলেন। সে সময় ১৫ কাঠার এ পানের জমিতে ২১০ কেজি খৈল ও ২০০ কেজি গোবর সার দিয়ে জমি চাষ করেন। আষাঢ় মাসে লতা রোপণের মাসখানেক পর সে জমিতে সারির মাঝে আবার ৪০ কেজি সরিষার খৈল চাপা দেন। বছরে পাঁচ থেকে ছয়বার খৈল চাপা দেন। এভাবে প্রথম বছর কেটে যায় এবং পানগাছগুলো লতিয়ে বড় হয়। কিন্তু এ বছর খৈলের সাথে সমাধান জৈবসার বাজার থেকে কিনে একইভাবে পিলির মাঝের মাটিতে মিশিয়ে সেই মাটি গোড়ার লতার ওপর তুলে দেন। এতেই যেন বেশি কাজ হয়। বিশেষ করে আশ্বিনে ও চৈত্রে তিন বস্তা খৈলের সাথে দুই বস্তা অর্থাৎ ১০০ কেজি সমাধান জৈবসার ব্যবহার করে যেন গাছের চেহারা বদলে যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছরের পাতার রঙ, আকার অনেক ভালো। এ জন্য দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, গাজীরহাট ও শিরোমণিরহাটে পান বেচতে নিয়ে গেলে সবাই বলে, তার পানই হাটের সেরা। স্থানীয় জৈবসার বিক্রেতা মন্মথ বাবু বলেন, এখন মহানন্দের মতো আরো অনেকে পানবরজে শুধু জৈবসার ব্যবহারে সুফল পাওয়ায় জৈবসারের বিক্রি বেড়ে গেছে। সমাধান জৈবসার উৎপাদনকারী শেখ গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘শহরের বাসাবাড়ির আবর্জনা সংগ্রহ করে পচিয়ে এই জৈবসার তৈরি করা হয়। তবে পানের বিশেষ বিশেষ পুষ্টি উপাদানের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে সেই জৈবসারে পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় ঘটানোর ফলে চাষিরা অধিক সুফল পাচ্ছেন।’
তবে উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘দিঘলিয়া উপজেলাতে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হচ্ছে। পানচাষিরা প্রচুর বিনিয়োগ করেন। পান একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল বিধায় এর নানা পর্যায়ে যত্নের দরকার হয়। তাই রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈবসার ব্যবহারে বরজের আয়ু বাড়তে পারে। তবে এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।’ সে যাই হোক, পান যেহেতু সরাসরি কাঁচা পাতা চিবিয়ে খাওয়া হয়, তাই কোনো রকম রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদ্ধতিতে পান চাষের ওপর জোর দেয়া খুব দরকার।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত