বেশির ভাগ মানুষের কাছে লজ্জাবতীগাছ কাঁটাওয়ালা আগাছা হিসেবে পরিচিত। কবিরাজ ছাড়া আর কারো কাছে তার কোনো দাম নেই। যেখানে সেখানে জন্মে চাষিদের বড্ড ঝামেলায় ফেলে। সাফ করতে খুব কষ্ট হয়। আর একবার কোথাও জন্মালে সহজে মরতে চায় না। অথচ এই লজ্জাবতী গাছকেই কাজে লাগিয়ে এখন জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। এই জৈব সার ফসলের জমিতে ব্যবহার করে ভালো ফসলও পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশে ভুট্টা ও বাজরার জমিতে এই জৈব সার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে অনেক আগেই। সম্প্রতি আমাদের দেশেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর লজ্জাবতীর জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে তা চাষিদের মধ্যে সম্প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে বলে রাখি, যে লজ্জাবতীগাছ থেকে জৈবসার তৈরি করা হয় সেটি কিন্তু মোটেই আমাদের দেশীয় লজ্জাবতীর গাছ নয়, থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীগাছ কাঁটাওয়ালা, ছোট, কাণ্ড তুলনামূলকভাবে শক্ত, বৃদ্ধি কম। তাই এই গাছ দিয়ে জৈব সার তৈরি করা বেশ ঝামেলার এবং বায়োমাস কম বলে কম জৈব পদার্থ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে বিদেশী তথা থাই লজ্জাবতী গাছে কোনো কাঁটা নেই বলে নাড়াচাড়া করতে খুব সুবিধে। এসব গাছ তাই আমাদের দেশে কাঁটাবিহীন লজ্জাবতী নামে পরিচিত। এই লজ্জাবতীগাছ দ্রুত বাড়ে, গাছ প্রায় ৩ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়। এ জন্য প্রচুর বায়োমাস পাওয়া যায়। গাছ নরম ও রসালো বলে দ্রুত পচে যায়। এ কারণে লজ্জাবতীগাছ থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশি জৈব সার পাওয়া যায়। এই জৈবসারে গাছের পুষ্টিও কম থাকে না। ২.০৩-২.৬ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.১৭৫-০.২৩ ভাগ ফসফরাস এবং ১‘.২৩৭-১.৭৪১ ভাগ পটাশিয়াম আছে। তাই অন্যান্য শিমজাতীয় গাছের মতো লজ্জাবতীগাছ থেকেও পুষ্টি পাওয়া যায়। এ জন্য এটা হতে পারে আগামী দিনে জৈব সারের একটি উত্তম উৎস। বিশেষ করে যেসব জমিতে সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা ব্যবহৃত হয় সেখানে ধৈঞ্চার বদলে লজ্জাবতীগাছও সবুজ সার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তা ছাড়া বাণিজ্যিক আমবাগানে চাষ দিয়ে লজ্জাবতীর বীজ বুনে দিলে সেসব বাগানের জমিকে লজ্জাবতীগাছ ঢেকে ফেলতে পারে। ফলে আমবাগানে আর আগাছা জন্মাতে পারে না এবং লজ্জাবতী গাছের শিকড়ে জন্মানো লালচে রঙের নডিউল বা গুটি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সঞ্চয় করে আমবাগানের মাটিতে সরবরাহ করে উর্বরতা বৃদ্ধি করে। থাইল্যান্ডে ভুট্টার জমিতে এভাবে লজ্জাবতীগাছ ব্যবহার করে ভুট্টার জমির আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং মাটির উর্বরতা ঠিক রাখা হয়। দিন দিন যেভাবে সারের দাম বাড়ছে তাতে চাষি ভাইয়েরা এখন অনেকেই আগের মতো জমিতে সার ব্যবহার করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমিতে সারের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সেজন্য এ ধরনের জৈব সার তাদের উপকার করতে পারে। লজ্জাবতী গাছের একটা বড় সুবিধা হলো যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও সে জন্মাতে পারে। তাছাড়া কোনো রোগপোকাও ধরে না বা কোনো বালাইয়ের বিকল্প পোষক হিসেবে কাজ করে না।
এ দেশে বোরো ধান কাটার পর মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রথম পশলা বৃষ্টির পর ধানের জমিতে একটা চাষ দিয়ে লজ্জাবতীর বীজ ছিটিয়ে বুনে দেয়া যায়। বীজ গজানোর পর বৃষ্টি পেয়ে গাছ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং জমিকে ঢেকে ফেলে। ফুল বা কুঁড়ি আসার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় এসব নরম সবুজ গাছ কুচি কুচি করে কেটে জমিতে চাষ দিয়ে মিশিয়ে দেয়া যায়। বোরো ধান কাটার পর যেসব জমি কিছু দিন খালি পড়ে থাকে সেসব জমিতে এভাবে লজ্জাবতীর সবুজ সার তৈরি করা যায়। রোপা আমনের চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে জমির সাথে চাষ দিয়ে এভাবে মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে আগের মৌসুমে চাষের জন্য বীজ দরকার।
এ দেশে বোরো ধান কাটার পর মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রথম পশলা বৃষ্টির পর ধানের জমিতে একটা চাষ দিয়ে লজ্জাবতীর বীজ ছিটিয়ে বুনে দেয়া যায়। বীজ গজানোর পর বৃষ্টি পেয়ে গাছ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং জমিকে ঢেকে ফেলে। ফুল বা কুঁড়ি আসার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় এসব নরম সবুজ গাছ কুচি কুচি করে কেটে জমিতে চাষ দিয়ে মিশিয়ে দেয়া যায়। বোরো ধান কাটার পর যেসব জমি কিছু দিন খালি পড়ে থাকে সেসব জমিতে এভাবে লজ্জাবতীর সবুজ সার তৈরি করা যায়। রোপা আমনের চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে জমির সাথে চাষ দিয়ে এভাবে মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে আগের মৌসুমে চাষের জন্য বীজ দরকার।
সে বীজের জন্য আলাদা একটা জায়গায় বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরপরই বীজ বুনে দিতে হবে। সেসব গাছে অক্টোবরে ফুল আসবে এবং ধীরে ধীরে সেসব ফুল থেকে ফল ও বীজ হবে। জানুয়ারিতে গিয়ে সেই বীজ সংগ্রহ করে রেখে পরের মৌসুমে বুনতে হবে। লজ্জাবতী গাছের বীজ সংগ্রহ করে সাথে সাথে বুনলে খুব কম গজায়। কেননা বীজের সুপ্তাবস্থা আছে। সুপ্তকাল ভাঙার জন্য বীজ বোনার আগে হালকা গরম পানিতে বীজ ভিজিয়ে নিলে ভালো গজায়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে বীজ বুনলে ভালো গজায়। তাই বর্ষাকালের আগে লজ্জাবতীর চাষ করতে হবে সবুজ সারের জন্য এবং বর্ষার পরে চাষ করতে হবে বীজের জন্য। গাজীপুরের সার্ডিতে কাঁটাবিহীন লজ্জাবতীকে এ পদ্ধতিতে চাষ করে সফলতা পাওয়া গেছে এবং বীজ উৎপাদন করে তা বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক রবীন্দ্র কুমার মজুমদার জানান।
এমনকি তিনি বর্ধনশীল লজ্জাবতীর গাছ কেটে কচুরিপানার মতো স্তূপ করে পচিয়ে জৈবসার তৈরি করতেও সক্ষম হন। এই সার অন্যান্য জৈব সারের মতো সবজি ক্ষেতেও ব্যবহার করা যায়। থাইল্যান্ডে এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর জমি থেকে লজ্জাবতীগাছ প্রায় ৩.০ থেকে ৩.৫ মেট্রিক টন শুষ্ক জৈব পদার্থ উৎপাদন করে। এ পরিমাণ বায়োমাস শুষ্ক জৈব পদার্থ থেকে ৬১ থেকে ৭২ কেজি নাইট্রোজেন/হে, ৫ থেকে ৬ কেজি ফসফরাস/হে এবং ৩৭ থেকে ৪৪ কেজি পটাশিয়াম/হে পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব যা আমাদের রাসায়নিক সারের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করতে পারে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত