স্ট্রবেরী সারা বিশ্বব্যাপি একটি জনপ্রিয় ফল। স্ট্রবেরী সাধারণত শীত প্রধান দেশের ফল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বর্তমানে নানা জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা শীতপ্রধান এমনকি ট্রপিক্যাল পরিবেশেও চাষ করা যেতে পারে। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে প্রায় ২,০০,০০০ হেক্টর জমিতে স্ট্রবেরীর চাষ হয় এবং প্রায় ৩০ লক্ষ মে. টন স্ট্রবেরী উৎপাদিত হয় (FAOSTAT, Database, 2011)। স্ট্রবেরী উৎপাদনে আমেরিকা প্রথম (২৭%)। এছাড়াও জাপান, রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশেও অনেক স্ট্রবেরী চাষের ব্যাপারে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আধুনিক স্ট্রবেরীর উৎপত্তিঃ
আধুনিক স্ট্রবেরী ফলের বৈজ্ঞানিক নাম Fragaria x ananassa। এটি Rosaceae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। আধুনিক স্ট্রবেরীFragaria x ananassa, Frageria chiloensis এবং Frageria verginian নামক দুটি বন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পরপরাগায়নের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। কথিত আছে যে, ফ্রেঞ্চ সেনা অফিসার আমিডে ফ্রানকোইচ ফ্রাজিয়ার, ফ্রাজারিয়া কিলোএনসিস, চিলি থেকে ফ্রান্সে নিয়ে আসেন। সে সময়ে ইউরোপে ফ্রাজারিয়া ভার্জিনিয়া নামক স্ট্রবেরীর চাষ হতো। ফ্রাজারিয়া কিলোএনসিস ইউরোপে আসার পর ফ্রাজারিয়া ভারজিনিয়ার পাশাপাশি এটির চাষ শুরু হয়। এদের মধ্যে পরপরাগায়নের ফলে সৃষ্টি হয় উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলী যুক্ত প্রাকৃতিক হাইব্রিড। ফ্রেন্স বিজ্ঞানী নিকোলাস ডাসনে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই হাইব্রিডটি সনাক্ত করেন এবং সুইজারল্যান্ডের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস এটির নাম করেন Fragaria x ananass । বর্তমানে পৃথিবীতে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ব্যবহৃত বেশীর ভাগ জাত Fragaria x ananass থেকে সৃষ্ট। উপমহাদেশের ন্যাটিভ স্ট্রবেরী জাতের বৈজ্ঞানিক নাম Fragaria indica।
স্ট্রবেরী একটি অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু ফল। স্ট্রবেরী গাছ দেখতে অনেকটা থানকুনি অথবা আলুর গাছের মত, তবে পাতা আরো বড় এবং চওড়া। এটি থানকুনি গাছের মতই রানারের মাধ্যমে চারা চারদিকে ছড়াতে থাকে। পাশ থেকে বের হওয়া পরিণত রানার কেটে আলাদা লাগিয়ে এর চাষ করা সম্ভব। তবে এর বীজ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। একটি স্ট্রবেরী গাছ থেকে রানারের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করলে বছরে কয়েকশত চারা উৎপাদন করা সম্ভব। স্ট্রবেরী শীত প্রধান দেশের ফল তাই বেশি তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ গাছ বাঁচিয়ে রাখা খুব কষ্টসাধ্য। স্ট্রবেরী ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় টকটকে লাল রঙের হয়। ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মত। স্ট্রবেরী জীবন রক্ষাকারী নানা পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে আছে ভিটামিন এ, সি, ই, ফলিক এসিড, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম, পলিফেনল, এলাজিক এসিড, ফেরালিক এসিড, কুমারিক এসিড, কুয়েরসিটিন, জ্যান্থোমাইসিন ও ফাইটোস্টেরল। এদের মধ্যে এলাজিক এসিড ক্যান্সার, বার্ধক্য, যৌনরোগ প্রতিরোধের গুণাগুণ আছে বলে জানা গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. মনজুর হোসেন ১৯৯৬ সালে জাপান থেকে একটি স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্য জাতের স্ট্রবেরী বাংলাদেশে আবাদের চেষ্টা করেন।
সংগ্রহ
স্ট্রবেরী নন-ক্লাইমেটিক ফল। স্ট্রবেরী দ্রুত পচনশীল ফলগুলোর অন্যতম। স্ট্রবেরী সংগ্রহের পর পরিপক্ক হয় না। সুতরাং ফলটিকে সঠিক পরিপক্কতার পর্যায়ে সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ফল এর ত্বক টকটকে লাল অথবা কোন সবুজ বা সাদা অংশ থাকবে না তখন ফল সংগ্রহ করলে সেই ফলের মিষ্টতা এবং স্বাদ উন্নতমানের হবে। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি (অক্টোবর মাসের শুরু) সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে। ফল পেকে লাল রঙ হলে ফল সংগ্রহ করতে হয়। হাত দিয়ে সাবধানে ফল সংগ্রহ করতে হবে যাতে ফলের গায়ে কোন ক্ষতি সৃষ্টি না হয় এবং ফল সংগ্রহের সময় বাছাই করে শুধুমাত্র পরিস্কার, অক্ষত ও আকার অনুযায়ী বাছাইকৃত ফল পৃথক প্যাকেটে রাখতে হবে। স্বচ্ছ প্লাষ্টিক প্যাকেটে বাছাইকৃত ফল সংগ্রহ করে বিক্রয়ের জন্য প্রস্ত্তত করা যেতে পারে। স্ট্রবেরির সংরক্ষণকাল খুব কম হওয়ায় ফল সংগ্রহের পর পরই তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে। ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে।
সংরক্ষণঃ
স্ট্রবেরী সংরক্ষণের উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ০-২০ সেলসিয়াস এবং উপযুক্ত আর্দ্রতা হচ্ছে ৯০-৯৫%। এই সুস্বাদু ফলটিকে আমাদের বাসার ডীপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব। ফলটিকে আংশিক খোলা প্লাস্টিক ব্যাগে করে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে করে সঠিক আর্দ্রতা বজার রাখা সম্ভব হয়। ফলটিকে সংরক্ষণের পূর্বে পানি দ্বারা ধেৌত না করাই উত্তম। পারি দ্বারা ধেৌত করলে অতিরিক্ত আর্দ্রতা শোষনের কারনে পচন তরান্বিত হয়।
বাজারজাতকরণঃ
স্ট্রবেরী বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়গুলি হচ্ছে ফল সংগ্রহ, পরিবহন, ডেলিভারি, দ্রুত-প্রিকুলিং, রেফ্রিজারেটেড সংরক্ষণ, রেফ্রিজারেটেড ট্রাকে পরিবহন ইত্যাদি। বাজারজাতের জন্য ০º সে. থেকে ২º সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ফল সাধারণ তাপমাত্রা ৩-৭ দিন পর্যমত্ম থাকে। রেফ্রিজারেটওে স্ট্রবেরী ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। তবে বিক্রির জন্য ফল পুরো লাল হওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ফলগুলো শক্ত থাকা অবস্থায় তুলতে হবে। আর ফল তুলতে হবে বোটা সমেত। ফল তোলার পর অতিদ্রুত বাজারজাত করাই উত্তম।পরে কাগজের প্যাকেটে করে বাজারজাত করতে হবে। ফল তোলার পর ১০-১২ দিন পর্যন- ভালো থাকে। গড়ে প্রতি গাছে ১৫০-২০০ গ্রাম ফল ধরে। ফলটি এদেশে নতুন তাই ঝুঁকিও বেশি। তবুও মেধা ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে স্ট্রবেরি চাষ একদিন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে সে কথা বলা যায়। স্ট্রবেরি সংরক্ষণ গুণ ও পরিবহন সহিষ্ণুতা কম হওয়ায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এর চাষ করা উত্তম।