বাউকুল-১
কুল (Zizyphus mauritiana) বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ফল। অম্ল−মধুর-মিষ্টি স্বাদের জন্য প্রায় সব বয়সের মানুষই কুল পছন্দ করে। বাংলাদেশেরআনাচে-কানাচে অনেক রকমের ও স্বাদের কুল চোখে পড়ে, তবে সচরাচর যে গুলো চাষ হয় তাহল- ঢাকা- ৯০, নারিকেলি, কুমিল্লা কুল, আপেল কুল, তাইওয়ান কুল ও থাইকুল। এই কুলগুলোর সাথে আর একটি কুলের নতুন সংযোজন- তা হল এফটিআইপি বাউকুল-১।
সু-স্বাদু, সুমিষ্ট, রং, রস, গুণ, সুগন্ধ, স্পর্শ ও মাধুরী মেশানো দৃষ্টি নন্দন বাউকুল-১ফলটিকে নির্দ্বিধায় বলা চলে, বাংলাদেশের বৈচিত্রময় ফল সম্ভারের মাঝে এক অভিনবঅলংকৃত সংযোজন।
এ কুলটিসৌন্দর্যের মাধুরী মেশানো রূপে-গুণে ভরপুর।
উদ্ভাবননিয়ে কিছুকথা
বাংলাদেশকৃষি প্রধান দেশ হলেও মাঠ ফসলের ক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু সফলতা এসেছে সে তুলনায় ফলউতপাদন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সফলতা অনেক কম। ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্প, উদ্যান তত্ত্ববিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ দেশের একক ও সর্ববৃহত ফলগাছেরসংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে, সুইচ এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) এবংইউনিভারসিটি গ্র্যান্ট কমিশন অব বাংলাদেশ (এসডিসি) এর অর্থে । যেখানে দেশ বিদেশেরবিভিন্ন জাতের ফলের গাছ/জাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, উতপাদন এবং তার উপর গবেষণা চালিয়েদেশে ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। এইগবেষণার ধারাবাহিকতায় প্রকল্প, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও ফিলিপাইন, সোমালিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে বেশ কিছু কুলের জাত সংগ্রহ এবং নির্বাচনেরমাধ্যমে বাউকুল-১ জাত বাছাই করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামানুসারে এইজাতের নামকরণ করা হয়েছে এফটিআইপি-বাউকুল- ১। (বাউ = BAU = Bangladesh Agriculture University)। জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা সম্ভাবক এই জাতটির উদ্ভাবকপ্রফেসর ডঃ এম এ রহিম।
পুষ্টিমূল্যওব্যবহার
কুলসাধারণত পাকা ও টাটকা অবস্থায় খাওয়া হয়। কুলের জাত ও পরিপক্কতার বিচারে এরখাদ্যমানের কিছুটা তারতম্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কুল খাদ্য হিসাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।বিভিন্ন খনিজ এবং ভিটামিন এ ও ভিটামিন সি এর একটি ভালো উতস হচ্ছে কুল। কুলে সাধারণত৮৫.৯ ভাগ পানি, ০.৮ ভাগ আমিষ, ০.১ ভাগ স্নেহ, ১২.৮ ভাগ লৌহ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রামশাঁসে ৫৫ ক্যালরি শক্তি, ৭০ আই. ইউ. ক্যারোটিন ও ৫০-১৫০ মিঃ গ্রাঃ ভিটামিন সিবিদ্যমান। কুল শুকিয়েও পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য ঘরে রেখে দেওয়া যায়। শুকনো কুলডালের সাথেও বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া কুল দিয়ে আচার, চাটনী, মোরব্বা, শরবত ও জেলী তৈরি করা যায়। তাছাড়া আয়ুর্বেদ চিকিতসা শাস্ত্রে কুলের বহুবিদব্যবহার উল্লেখ রয়েছে। কুল গাছে Techardia laccad নামক এক প্রকার অতি ক্ষুত্র পোকালালন করে গালা তৈরী করা যায়।
লাভজনকফলের চাষবাউকুল
বাড়ীরআশে-পাশে এবং অনেকের অনেক পতিত জমি আছে। যা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে এরব্যবহার করা সম্ভব হয় না। যদি ঐ পতিত জমি ব্যবহারের ব্যাপারে একটু ঠান্ডা মাথায়চিন্তা করা হয়, তা হলেই এর সমাধান পাওয়া যাবে। আমাদের প্রথমে চিন্তা করতে হবে কিকরে- নূন্যতম খরচ করে, স্বল্পতম সময়ে, সহজ উপায়ে, অপেক্ষাকৃত কম ব্যবস্থাপনায়, নিশ্চিত ও সর্বোপরি লাভজনক চাষ করতে চাই, এর উত্তর খুবই সহজ। আর তা হচ্ছে ফলের চাষএবং তা অবশ্যই বাউকুলের চাষ। আমরা অত্যন্ত পরিক্ষীত এবং আত্ম বিশ্বাসের সাথেই বলছিবাউকুল-১ ই হচ্ছে প্রশড়ব গুলোর উত্তর এবং বর্তমান সময়ের লাভজনক ফলের চাষ।
একটিহিসাব
বাউকুল-১গাছ লাগানোর ৪/৫ মাসের মধ্যে বানিজ্যিক ভিত্তিতে ফল পাওয়া যাবে। ৪/৫ মাসের একটিগাছ থেকে কমপক্ষে ১০ কেজি কুল পাবেন, যা থেকে ৫০/- টাকা কেজি পাইকারী মূল্য হিসাবেআয় হয় ৫০০/- টাকা। এই হিসাবে একরে ৪৪৫টি গাছ থেকে ২য় বছরে (৩০ কেজি/গাছ ধরে) আয়হবে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা।
বাউকুল-১বাগান স্থাপনেকরনীয়
প্রকৃতমাতৃগাছসংগ্রহ
বাগান করারপূর্ব শর্ত হচ্ছে প্রকৃত মাতৃগাছ সংগ্রহ করা। বংশানুক্রমিক (Pedigree) মাতৃগাছছাড়া জাতের বিশুদ্ধতা থাকবে না এবং ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে না। বড় বড় প্রায় সবনার্সারীতেই এখন বাউকুলের পাওয়া যাচ্ছে। যেমনঃ আজাদ হাইব্রিড হর্টিকালচার সেন্টার, কিংশুক নার্সারি, ব্রাক নার্সারি ইত্যাদি।
জলবায়ু, মাটিও রোপন
কুলগাছঅত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু এবং এর পরিবেশিক উপযোগিতা খুবই ব্যাপক। সাধারণত শুষ্ক ও উষ্ণজলবায়ু কুল চাষের জন্য সর্বোত্তম। এতে কুলের ফলন ও গুনাগুন দুই’ই ভাল হয়।অতিরিক্ত আর্দ্রতা কুল চাষের জন্য ভাল নয়। বাউকুল - ১ সারা বছরই লাগানো যায়। তবেবর্ষামৌসুমে লাগানো উত্তম। গভীর দোঁআশ বা উর্বর মাটি কুল চাষের জন্য অত্যন্তউপযোগী। জমি ভাল ভাবে চাষ করে বাউকুল-১ এর জন্য ১০ x ৭ ফুট অর্থাত লাইন থেকে লাইন১০ ফুট এবং চারা থেকে চারা ৭ ফুট দূরত্বে ৩ ফুট বৃত্তাকারে ও ২ ফুট গভীর করে গর্তকরতে হবে।
সারব্যবস্থাপনা
বাউকুল-১এর কলম চারা রোপন করার ১৫/২০ দিন পূর্বে গর্তে ২০-২৫ কেজি গোবর সার, ২০০ গ্রামটি.এস.পি, ২০০ গ্রাম এম.ও.পি এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে মাটিখুব উর্বর হলে রাসায়নিক সার দেওয়ার দরকার হয় না। রোপনের বছর বর্ষার আগে ও পরেগাছ প্রতি ৫০ গ্রাম করে টি.এস.পি এবং এম.ও.পি সার ও ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগকরতে হবে। তবে গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সার প্রয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে।একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ৩০-৪০ কেজি পচা গোবর সার, ৫০০-৬০০ গ্রাম করে টি.এস.পি এবংএম.ও.পি সার ও ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া গাছের গোড়া থেকে চারপাশে ৫০ সে.মি. বাদ রেখে ঐগাছের ডালপালা যে পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে সে পরিমাণ জমিতে প্রয়োগ করে ভালোভাবে মাটিরসাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এই সময় বর্ষা না থাকলে প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে। বাউকুল-১সম্পূর্ণ জৈব উপায়েও চাষাবাদ করা যায়।
বংশবিস্তার
ফলেরগুণাগুণ রক্ষার জন্য বাউকুল-১ কুঁড়ি সংযোজন ও জোড় কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করাহয়।
সেচওনিস্কাশন
বর্ষাকালেপানি নিস্কাশন ও খরা মৌসুমে নিয়মিত সেচ প্রদান করা দরকার।
অন্যান্যপরিচর্যা
কুলগাছেরসাধারণত নতুন গজানো চলতি বছরের প্রশাখায় ফল ধরে, তাই কুলগাছের বৃদ্ধি ও পরিমিত ফলধারনের জন্য অঙ্গ ছাঁটাই একটি অতীব জরুরী ও অত্যাবশ্যক কাজ। সময়মত ও সঠিক জায়গায়ছাঁটাই না করলে আপনার বাগান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কলম চারা মাটিতে লাগানোর পরলক্ষ্য রাখতে হবে যেন কলম চারার জোড়াকৃত অংশের নীচে কোন ডালপালা না গজায় অর্থাতজোড়াকৃত অংশের নীচের অপ্রযোজনীয় ডাল সবসময় কেটে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। মার্চেরশেষের দিকে ৪-৫ ফুট উচ্চাতায় মূল কান্ড রেখে বাকী ডাল কেটে ফেলতে হবে। কাটাঅংশটিতে আলকাতরা দিয়ে দিতে হবে। এরপর কর্তিত গাছে প্রচুর পরিমান নতুন কুঁশি বেরহবে। এরপর মাটি থেকে ২-৩ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত নতুন কুঁশি কেটে দিতে হবে। এতে উপরেরঅংশের শাখা-প্রশাখা ছাতার মতো আকার ধারণ করবে ও ঝাঁকড়া হবে। ফলন্ত গাছের বেলায়প্রতি বছর মৌসুমী ফল সংগ্রহের পর ফল ধারনকারী ডাল সমূহ গোড়ার দিকে ৪০-৫০ স.মি.রেখে কেটে ফেলতে হবে। তবে কুলচাষে ভাল ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন কুল বাগানেরমধ্যে বা আশেপাশে কোন জংলী বরই না থাকে। কেননা এগুলো পাউডারী মিলডিউ রোগের জীবানু ওফলের মাছি পোকার পোষক হিসাবে কাজ করে।
টব/অর্ধড্রামেবাউকুলচাষ
ড্রামেবাউকুল-১ এর চাষ সফল ভাবে করা যেতে পারে। মাটির তৈরী টব অথবা অর্ধ এজন্য সমপরিমানমাটি ও পচা গোবর সার (অর্ধেক মাটি + অর্ধেক পচা গোবর সার) ভালোভাবে মিশিয়ে টব/অর্ধড্রামে নিয়ে চারা কলম লাগাতে হবে। এ জন্য কোন রাসায়নিক সার দেওয়ার প্রয়োজননেই। তবে গাছের নতুন কচি পাতা বের হয়ে তা পরিপক্ক হওয়ার পর ২-৩টি ট্যাবলেট সার (সিলভার ম্যাক্স/সিলভামিক্স ফোর্ট) গাছের গোড়া থেকে ৫-৭সে.মি. দূরে মাটির৫-৭সে.মি. গভীরে পুঁতে দিতে হবে। তবে টব/অর্ধ ড্রামকৃত গাছে প্রয়োজন অনুসারেনিয়মিত সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পোকামাকড়ওরোগবালাই
মাছি পোকা, শুঁয়া কীড়া শাঁসালো ও পাকা কুলের শাঁসের মধ্যে ঢুকে শাঁস খেতে খেতে আঁটি পর্যন্তপৌঁছে যায়। অনেক সময় আক্রান্ত ফল পচে যায়। শুঁয়া পোকা কচি পাতা থেকে শুরু করেবয়স্ক পাতা খেয়ে অনেক সময় গাছকে নিষ্পত্র করে ফেলে। লাক্ষা পোকা কচি বিটপেপ্রথমে আক্রান্ত করে। পরবর্তীতে সাদাটে লাল পোকা (লাক্ষা) গুলো দ্বারা শাখা-প্রশাখাআক্রান্ত হয়ে শুকাতে থাকে। উপরোক্ত এ পোকাগুলো দমনের জন্য ডেসিস/সিমবুশ প্রতি ১০লি. পানিতে ২৫ মি.লি. প্রয়োগ করে সহজেই দমন করা যায়। এছাড়া কুলগাছে সাদা মাছিপোকার আক্রমনও লক্ষ্য করা যায়। এ জন্য ১০ গ্রাম/লি. হারে ডিটারজেন্ট পাউডার স্প্রেকরে এ পোকা সহজেই দমন করা যায়।
কুল গাছেসাধারণত পাউডারী মিলডিউ ও ফলের পচন রোগ দেখা যায়। এ রোগ দমনের জন্য ১%বোর্দোমিশ্রন বা কম্পানিয়ন প্রতি ১০ লি. পানিতে ২০ গ্রাম ভালভাবে মিশিয়ে প্রতি৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়। কুলগাছে বর্তমানে যে রোগটিসবচেয়ে মারাত্মক ভাবে আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়, তা হল- শ্যুটি মোল্ড রোগ অর্থাতপাতা ও কান্ডে কালো স্পট পড়ে। এ জন্য ডিটারজেন্ট পাউডার (১০ গ্রাম/লিটার) দিয়েপাতা ভালো ভাবে ধুয়ে পরিস্কার করে এ রোগ দমন করা যেতে পারে।
ফলন
ভাল যত্নকরলে বাউকুল-১ জাতের এক বছরের গাছ থেকে একর প্রতি ৬-৭ হাজার কেজি ফল পাওয়া যায়।
দুটিকথাঃ
আমাদেরপ্রতিদিন গড়ে ৪৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। আবার প্রয়োজনীয় খাদ্যশক্তির শতকরা২.৫ ভাগ ফল থেকে আসলে একজন মানুষের শরীর তাত্ত্বিক ও মানবিক স্বাভাবিক সুস্থতাবজায় থাকে। বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু ফল ভক্ষণের পরিমাণ ৪০ গ্রামেরও কম।এমতাবস্থায় কোন মানুষের শারীরিক ও মানষিক ভাবে পরিপূর্ণ বিকাশ হতে পারে না। এদেশের বেশির ভাগ লোক গরীব বিধায় এদের ফল ক্রয় করে খাওয়ার সাধ জাগলেও সাধ্যেকুলায় না। ফলশ্রুতিতে মাথাপিছু যতটুকু ফল খাওয়া উচিত তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়।বাংলাদেশে দিন দিন ভূমিহীন লোকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বসত বাড়িতে ফলচাষের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার এমন বসত বাড়ি পাওয়া যাবে না, যেখানে ২/১টি ফলের গাছ নেই। এই সমস্ত বসত বাড়িতে ২/১টি বাউ কুলের গাছ লাগানো যেতেপারে। এতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে। তাতে নিজের ফলের চাহিদা মিটিয়েকিছু অর্থ উপার্জনের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
শাবাবমুস্তফা
তথ্যসূত্র : forum.amaderprojukti.com
আজাদহাইব্রিডহর্টিকালচার সেন্টার
জার্মপ্লাজমসেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ
বাউকুল-১
Monday, August 2, 2010
Labels:
ফল-মূল চাষ
Posted by
আমাদের রান্না
at
1:02 AM