উন্নত জাতের লিচু চাষ

Saturday, August 7, 2010


লিচু হলো বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক ফল। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে ফলটি এ মর্যাদা পেয়ে আসছে। সত্যি বলতে কি, বিশ্বে প্রথম ফল চাষের বই লেখা হয়েছিল ১০৫৬ সালে, সেটিও ছিল লিচুকে নিয়ে। বিশ্বের অনেক রাজা-বাদশাহ রানী-বেগমদের মন জয় করতে যুগে যুগে লিচু ফল উপহার দিয়েছেন। অষ্টম শতকে চীনা সম্রাট হুয়ান সাংও একই কাজ করে বেগমের মন জয় করেছিলেন, দক্ষিণ চীন থেকে লিচু বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুদূর উত্তর চীনে।

উন্নত জাত
বিজ্ঞানীরা নানা জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও বের করেছে লিচুর তিনটি জাত। এ দেশে যেসব জাতের লিচু পাওয়া যায় সেগুলো হলোন্ধ বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ি, মোজাফ্ফরপুরী, বেদানা লিচু, বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩ ইত্যাদি। বোম্বাই লিচু টকটকে লাল, মাদ্রাজি আগাম জাত, সবচেয়ে ভালো জাত চায়না-৩। এই জাতের গাছে প্রতি বছরই ভালো ফল ধরে। বেদানা নাবী জাত। বারি লিচু-১ আগাম জাত, বারি লিচু-৩ মাঝ মৌসুমি জাত। কিন্তু বারি লিচু-২ নাবী জাত। লাগানোর জন্য এসব জাত থেকে যেকোনো জাত নির্বাচন করা যেতে পারে।

চারা কলম
বীজ থেকে ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে লিচুর চারা তৈরি করা যায়। কিন্তু বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে ফল ধরতে ৭-১২ বছর সময় লাগে। এ জন্য বীজ থেকে সাধারণত চারা উৎপাদন করা হয় না। চারা উৎপাদনের জন্য গুটিকলম লিচুর ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপযোগী। তবে এ পদ্ধতি ছাড়া জোড়কলম, কুঁড়ি সংযোজন, ছেদ কলম প্রভৃতির মাধ্যমে সফলভাবে চারা উৎপাদন করা যায়। গুটি কলম তৈরি করার সময় কাটা জায়গায় অনুমোদিত হরমোন মিশিয়ে লাগালে মূল গঠন ভালো হয়।

চাষাবাদ
পরিকল্পিতভাবে লিচুবাগান করতে হলে বাগান তৈরির বা চারা রোপণের কয়েক বছর আগে দ্রুতবৃদ্ধিশীল লম্বা-দৃঢ় জাতের কিছু গাছ যেমনন্ধ ইউক্যালিপ্টাস, জাম, শিমুল প্রভৃতি রোপণ করতে হবে। অথবা যে জমির চার দিকে বা আশপাশে এ ধরনের গাছ আছে সে জমি বাগানের জন্য নির্বাচন করতে হবে। এতে ফল ঝরা, ফল ফাটা প্রভৃতি হন্সাস পায় এবং ঝড় বাতাসে গাছের ক্ষতি কম হয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে জমি তৈরি করে জমি সমান করতে হবে। মে-জুন মাসে জমি তৈরি করা ভালো। জমিতে বর্গাকার বা ষড়ভুজি রোপণপ্রণালী অনুসরণ করে ১০ মিটার দূরে দূরে ১ মিটার ১ মিটার ১ মিটার আকারের গর্ত খনন করতে হবে। রোপণের কয়েক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে গর্ত করা উচিত। গর্ত করার পর গর্তের ওপরের মাটির সাথে গর্তপ্রতি ২০-২৫ কেজি জৈবসার, ২ কেজি হাড়ের গুঁড়ো বা ৫ কেজি কাঠের ছাই মিশিয়ে গর্ত ভরে দিতে হবে। তারপর তাতে পানি দিয়ে কিছু দিন রেখে দিয়ে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গর্তের মাটির সাথে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও এমওপি মিশিয়ে গর্তের মাঝখানে লিচুর চারা বা গুটিকলম লাগাতে হবে। লাগানোর পরপরই গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে কিছু পাতা ছাঁটাই করা ভালো।
প্রতি বছর তিনবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি, মে ও অক্টোবর-নভেম্বরে সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের বছর সার কম দিলেও বয়স বাড়ার সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সারের পরিমাণ হলোন্ধ

এক থেকে তিন বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ১০-২০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ১৫০-২০০ গ্রাম।
চার-ছয় বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ২০-৩০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম।
৭-১০ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৩০-৪৫ কেজি, ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম, টিএসপি৭০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম।
১০ বছরের বেশি বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৫০-৬০ কেজি, ইউরিয়া ১০০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম।
গাছে যদি জিঙ্কের অভাব দেখা দেয় অর্থাৎ পাতা যদি তামাটে রঙ ধারণ করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার পানির সাথে ২ কেজি চুন ও ৪ কেজি জিঙ্ক সালফেট গুলে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। ফল ঝরা কমাতে এটা সাহায্য করবে। ফল ফেটে যাওয়া কমাতে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম বোরিক পাউডার গুলে ফলে স্প্রে করা যেতে পারে।

আবহাওয়া ও মাটির ধরন অনুসারে শীতকালে ১০-১২ দিন ও গ্রীষ্মকালে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হয়। তবে সারা বছর ১২৫ সেন্টিমিটারের বেশি সুষমভাবে বৃষ্টিপাত হলে সেচ না দিলেও চলে। ফল ধরার পর নিয়মিত পানি সেচ দিলে ফলন বেড়ে যায়। ফল না ধরা পর্যন্ত লিচুবাগানে খরিপ ঋতুতে শসা, কুমড়া, ঝিঙ্গা, উচ্ছে বা করলা, মাষকলাই, গো মোটর প্রভৃতি এবং রবি ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি চাষ করা যায়। ফলসা, আনারস, কলা, পেঁপে প্রভৃতি ফলও আন্ত:শস্য হিসেবে চাষ করা যায়।

ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লিচুগাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় ফলের খোসা লালচে রঙ ধারণ করে ও কাঁটাগুলো চ্যাপ্টা হয়ে খোসা প্রায় মসৃণ হয়ে যায়। কয়েকটি পাতাসহ গোছা ধরে লিচু সংগ্রহ করা হয় এতে ফল বেশি দিন ধরে ঘরে রাখা যায়। বৃষ্টি হলে তার পর পরই কখনো লিচু সংগ্রহ করা ঠিক নয়। সাধারণত লিচুগাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। তবে ২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত লিচুগাছে ফলন বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়। অবস্খাভেদে এর তারতম্যও লক্ষ করা যায়।

তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত

মনের উঠোনে

সাম্প্রতিক সংযোজন

মোবাইল থেকে দেখুন

আমাদের দেশ এখন আপনার মুঠোফোনে, মোবাইল থেকে লগইন করুন আমাদের দেশ

দ র্শ না র্থী

দ র্শ না র্থী

free counters

কে কে অনলাইনে আছেন