জৈবসার তৈরির প্রস্তুত প্রনালী
বসত বাড়ীর জৈব সার কারখানা
মাটির গঠন ওগুণাগুণ ঠিক রাখতে হলে জৈব সার ব্যবহার করেই একে উৎপাদনক্ষম করতেহবে।তাইজৈব সার তৈরী ও সংরক্ষণের ব্যাপারেপ্রত্যেককৃষক ভাইয়ের যত্নবান হওয়া উচিত।সামান্য উদ্যোগ নিয়ে নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগিয়ে প্রায় বিনাখরচে জৈব সার তৈরী করা সম্ভব।নিজস্ব শ্রম ও গৃহস্থলী থেকে প্রাপ্ত খড়কুটালতাপাতা, কচুরিপানা, ছাই, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা,
গোবরগো-চনা, বাড়িঘর ঝাড়ু দেয়া আবর্জনা ইত্যাদি পচিয়ে বা সংরক্ষণ করেপ্রত্যেক কৃষক বাড়িতে ছোটখাটো একটি সার কারখানা গড়ে তুলতে পারে।এই জৈব সার ব্যবহারেমাটির উৎপাদিকাশক্তি যেমন ঠিকথাকবে ঠিক থাকবে অন্যদিকে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীলতাও কিছুটা হ্রাসপাবে।
গোবর সার সংরক্ষণপদ্ধতি
গরুর মলমূত্র একত্রে মিশিয়ে ও পঁচিয়ে যে সার তৈরী করা হয়তাই গোবর সার।এই সার বাংলাদেশের কৃষকের কাছে অত্যন্ত পরিচিত ও উত্তমমানের সার।এত অধিক পরিমাণ জৈব সার অন্য কোনো গৃহপালিত পশুপাখি থেকেপাওয়া যায় না।কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে এত মূল্যাবান সারটির বিরাটঅংশ বিনষ্ট হয়ে থাকে।গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় অযত্ন ও অনিয়মে গোবর জড় করে রাখাহয়।অনেকে গর্ত করে গোবর সংরক্ষণ করেন ঠিকই কিন্তু উপরে আচ্ছাদন না থাকায় রোদ ও বৃষ্টিরপানিতে নষ্ট হয়ে যায়।কাজেই এভাবে যে সার তৈরী করা হয় তা মাটি বা ফসলের জন্য কোনোকাজে আসে না।এ ছাড়া আজকাল গোবরকে জ্বালানি হিসাবেও ব্যাপকভাবে ব্যবহারকরা হচ্ছে।এতে সম্পদের একক ব্যবহারে জমিতে সারের ঘাটতি দেখাদিচ্ছে।অথচ এই গোবরকে বায়ো-গ্যাম হিসাবে ব্যবহার করার পরেও সারহিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব।সরাসরি গোবরকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করার ফলেএক-তৃতীয়াংশ গোবর সার বিনষ্ট হচ্ছে।প্রতিদিন যেটুকু গোবর পাওয়া যায় তা সযত্নেসংরক্ষণ করা উচিত।কারন কাঁচা গোবর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক নয়।আবার সাধারণত গোবরজমা করে রাখলেও সারের গুণগত মান নষ্ট হয়।
উন্নত পদ্ধতিতে যেভাবে গোবর সারতৈরী করবেন
১।গোয়াল ঘরের কাছাকাছি সামান্য উঁচু স্থান বেছে নিয়ে ১.৫মিটার চওড়া, ৩ মিটার লম্বা ও ১মিটার গভীর গর্ত তৈরী করুন।গোবরের পরিমাণ বুঝেগর্ত ছোট, বড় বা একাধিক গর্ত করতে পারেন।
২।গর্তের তলা ভালোভাবে পিটিয়ে সেখানে খড়/কাঁকর/বালি বিছিয়েনিন যাতে পানি সহজে শুষে নিতে পারে অথবা গর্তের তলা এবং চারপাশে গোবর দিয়ে ভালভাবেলেপে নিতে পারেন।গর্তের চারিদিকেই তলদেশের দিকে একটু ঢালু রাখতে হবে এবংগর্তের উপরে চারপাশে আইল দিয়ে উঁচু করে রাখতে হবে যেন বর্ষার পানি গর্তে যেতে নাপারে।
৩।গর্তের পাশ থেকেগোবর ফেলে গর্তটি ভরতে থাকুন অথবা গর্তটিকে কয়েকটি ভাগেভাগ করে কয়েক দিনে এক একটিঅংশ ভরে পুরো গর্ত ভরাট করা ভালো।
৪।গর্তে গোবর ফলারফাঁকে ফাঁকে পুকুর বা ডোবার তলার মিহি মাটি ফেলুন, এতে স্তর আঁটসাট হয়এবং সার গ্যাস হয়ে উবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
৫।প্রায় দেড় মাস পর সারের গাদা ওলটপালট করে দিতেহবে।যদিগাদা শুকিয়ে যায় তবে গো-চনা দিয়ে ভিজিয়ে দিন কারণ, গো-চনাও একটিউৎকৃষ্টসার।
৬।গোবরের সাথে টিআসপি (ঞঝচ) ব্যবহার করলে জৈব সারের মান ভালো হয়।গোবরের গাদার প্রতি টনের জন্য ১৫-২০ কেজিটিএসপি ব্যবহার করতে পারেন।
৭।কড়া রোদে গোবর যেনশুকিয়ে না যায় আবার বৃষ্টিতে ধুয়ে না যায় সে জন্য গাদার ওপরে চালা দিয়েদিন।খড়, খেজুর পাতা কিংবা তালপাতা দিয়ে কম খরচে এই চালা তৈরী করতেপারেন।
এমনিভাবে সংরক্ষণের ২ মাসের মধ্যেইগোবর পচে উত্তম মানের সার তৈরী হয় যা পরবর্তীতে জমিতে ব্যবহার করার উপযোগীহয়।জৈবসার ব্যবহার করে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভশীলতা কমিয়ে আনুন এবং পরিবেশ সংরক্ষণেসচেষ্ট হন।
প্রফেসর ডঃমোঃ সদরুলআমিন উদ্ভাবিত বায়োএক্টিভেটেড পদ্ধতিতে সহজেই ২৮ দিনে উন্নত মানেরকম্পোস্ট তৈরী করা।
কচুরি পানাদিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরী
কম্পোস্ট তৈরীর আসল কাঁচামাল কচুরিপানা ছাড়াওখড়কুটা, ঝরাপাতা, আগাছা, আবর্জনা, ফসলের অবশিষ্টাংশ একত্রে মিশিয়ে পচানো হয়-যা থেকেউৎকৃষ্টমানের কম্পোস্ট উৎপাদন সম্ভব।বর্ষায় বাংলাদেশেডোবা-নালাসহ জালাঞ্চলগুলো কচুরিপানায় ভরে ওঠে।যার ফলে পানি দূষিত হয় এবং মশার উপদ্রববাড়ে।অথচ এই কচুরিপানাকেই আমরা কম্পোস্টের আসল কাঁচামাল হিসাবেগণ্য করতে পারি।আমরা সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে কম্পোস্ট তৈরী করতেপারি-
১।স্তূপপদ্ধতি
স্তূপ পদ্ধতি
অতিবৃষ্টি ও বন্যাযুক্ত এলাকার জন্য স্তূপবা গাদা পদ্ধতিতে কম্পোস্ট সার তৈরী করতে হবে।বসতবাড়ির আশপাশে, পুকুর বা ডোবার ধারেকিংবা ক্ষেতের ধারে যেখানে বন্যার কিংবা বৃষ্টির পানি দাঁড়াবার কোন সম্ভাবনা নেইএমন জায়গাকে স্তূপ পদ্ধতিতে কম্পোস্ট সার তৈরীর স্থান হিসাবে নির্বাচন করতেহবে।স্তূপের উপরে চালা দিতে হবে অথবা গাছর নিচে স্থান নির্বাচনকরতে হবে যাতে রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়।
স্তূপের আকার
এই পদ্ধতিতেগাছের ছায়ায় মাটির ওপর ৩ মিটার দৈর্ঘ্য ১.২৫ মিটার প্রস্থ ও ১.২৫ মিটার উচুঁ গাদাতৈরী করুন।আপনার সুবিধা অনুযায়ী এই মাপ কম-বেশি করতেপারেন।প্রথমত কচুরিপানা অথবা অন্যান্য আবর্জনা ফেলে ১৫ সে. মিটারস্তূপ তৈরী করুন।স্তর সাজানোর আগে কচুরিপানা টুকরা করে ২/৩ দিন রোদে শুকিয়েনিতে হবে।এবার সাজানো স্তরের ওপর ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০০ গ্রামটিএসপি ছিটিয়ে দেয়ার পর স্তরের উপরিভাগে ২.৫/৫ সে. মি. পুরু করে কাদা ও গোবরেরপ্রলেপ দিয়ে দিন।এতে পচন ক্রিয়ার গতি যেমন বাড়বে অন্যদিকে সুপার কম্পোস্টতৈরী হবে।এভাবে ১.২৫ মিটার উঁচু না হওয়া পর্যন্ত ১৫ সে. মি. পুরুস্তর সাজানোর পর পর ইউরিয়া ও টিএসপি দিয়ে তার ওপর গোবর ও কাদা মাটির প্রলেপদিন।গাদা তৈরী শেষ হয়ে গেলে গাদার ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে ছাউনিরব্যবস্থা করুন।
কম্পোস্টস্তূপ পরীক্ষা
কম্পোস্ট স্তূপ তৈরী করার এক সপ্তাহ পর শক্ত কাঠি গাদারমাঝখানে ঢুকিয়ে দেখুন গাদা অতিরিক্ত ভেজা কিনা।যদি ভেজা হয় তবেগাদার উপরিভাগে বিভিন্ন অংশে কাঠি দিয়ে ছিদ্র করে দিনে যেন বাতাস ঢুকতেপারে।২/৩ দিন পর গর্ত বা ছিদ্রগুলো মাটি দিয়ে বন্ধ করেদিন।
আবার গাদা অতিরিক্ত শুকিয়ে গেলে ছিদ্র করেপানি অথবা গো-চনা ঢেলে দিন।এতে সার ভালো হবে।কম্পোস্ট তাড়াতাড়ি পচে সার হওয়ার জন্য স্তরসাজানোর ১ মাস পর প্রথমবার এবং ২ মাস পর দ্বিতীয় বার গাদার স্তরগুলো উল্টিয়েদিন।এসময় কম পচা আবর্জনাগুলো গাদার মাঝখানে রাখুন।আবর্জনা সার ঠিকমতো পচলে ধূসর বা কালো বর্ণধারণ করবে এবং আঙ্গুলে চাপ দিলে যদি গুঁড়া হয়ে যায় তবে মনে করবেন মাঠে ব্যবহারেরউপযোগী হয়েছে।উল্লেখিত পর্দাথের মাপগুলো যদি ঠিকমত দেয়া হয় তবে এ জাতীয়কম্পোস্ট গাদা ৩ মাসের মধ্যে উন্নতমানের সারে রূপান্তরিত হয়। (চলবে)
তথ্য সূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষেরচাষবাস’গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত