জৈবসার তৈরির প্রস্তুত প্রনালী
২।গর্ত পদ্ধতি
গর্তপদ্ধতি
পানি দাঁড়ায় না কিংবা কম বৃষ্টিপাত এলাকা কিংবা শুকনোমৌসুমে গর্ত পদ্ধতিতে কম্পোস্ট তৈরী করা যঅয়।গাছের ছায়ার নিচে বাড়ির পেছন দিকে অথবাগোশালার পাশেই কম্পোস্ট গর্ত তৈরী করা সব দিক থেকে সুবিধাজনক।
আপনার প্রাপ্ত স্থানের সাথে সঙ্গতি রেখে গর্ত তৈরীকরুন।তবে ১.২৫ মিটার প্রস্থ, ১ মিটার গভীর ও ২.৫মিটার দৈর্ঘ্যের একটি গর্ত তৈরী করুন।
গর্তের তলায় বালু অথবা কাঁকর দিয়ে দরমুজ করে দিন যাতে জলীয়পদার্থ শোষণ করে নিতে পারে।প্রয়োজনে ধানের খড়ও বিছিয়ে দিতে পারেন, তাও সম্ভব না হলেগোবর কাদার সাথে মিশিয়ে গর্তের তলা এবং চারপাশে লেপে দিন।মনে রাখবেন গর্তেরওপর দিকে ভুমি থেকে খানিকটা উঁচু করে আইল তৈরী করে দিতে হবে যাতে কোন রকমে পানিগড়িয়ে গর্তে পড়তে না পারে।
এবার গাদাপদ্ধতির মতো করে গর্তে কচুরিপানা স্তরে স্তরে সাজিয়ে কম্পোস্ট তৈরীকরুন।অথবা গোয়াল ঘরে গোবর, গো-চনা, পাতা, আখের ছোবড়া, কলাপাতা যাবতীয়উচ্ছিষ্ট অংশ গর্তে ফেলুন।সম্ভব হলে গো-চনার সাথে কাঠের গুঁগা মিশিয়ে দিতে পারলে ভালহয়।
এমনি এক একটি স্তরের ওপর মাটির প্রলেপদিয়ে দিন।মনে রাখবেন, মাটির প্রলেপ দেয়ার আগে স্তর ভালভাবে ঠেসেদিতে হবে।গর্ত ভরাট না হওয়া পর্যন্ত এমনিভাবে স্তর তৈরীকরুন।
প্রত্যেকটি স্তর তৈরীর পর মাটির প্রলেপদেয়ার আগে পরিমান মতো ইউরিয়া সার ছিটিয়ে দিন।এরূপ একটি গর্তে তিনটন আবর্জনার জন্য ১/২ কেজি ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে।গর্ত ভরাট হয়েযাওয়ার পর গোবর ও মাটি মিশিয়ে উপরিভাগে প্রলেপ দিয়ে দিন।
সার যাতে শুকিয়ে না যায় তা পরীক্ষা করতে হবে।গর্তের মাঝখানেছিদ্র করে দেখতে হবে, যদি শুকনো মনে হয় তবে ছিদ্র দিয়ে পানি ঢালতেহবে।জৈবপদার্থে পানির পরিমাণ ৬০-৭০ ভাগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
এভাবে তিন মাস রাখার পর এই সার ব্যবহার উপযোগীহবে।
কম্পোস্ট ব্যবহারেরনিয়ম
ধান পাট, আলু, গম ও শাকসবজির মাঠে কম্পোস্ট ব্যবহার করা যায়।বেলেদোআঁশ, বারিন্দ্র ও লালমাটি এবং মধুপুরগড় এলাকার জন্য কাম্পোস্টবেশ কার্যকারী।কম্পোস্ট জমিতে ছিটিয়ে দেয়ার সাথে চাষ দিয়ে মাটির সাথমিশিয়ে দিন।
প্রত্যেকবাড়িতে জৈব সার কারখানা গড়ে তুলুন
লতাপাতা ওগাছগাছলি দিয়ে সবুজ সার তৈরী
সবুজ সার কী? এরকম প্রশ্ন উথাপিতহওয়া স্বাভাবিক।এ প্রশ্নের সহজতর জবাব হচ্ছে-কোনো উদ্ভিদকে সবুজ অবস্থায়চাষ দিয়ে মাটির সাথে মেশানোর ফলে পচে গিয়ে যে সার তৈরী হয়, তাকেই সবুজ সারবলে।অন্য কথায় বলা যায় যে, মাটির জৈব পদার্থের ক্ষয়পূরণ বা বৃদ্ধিরউদ্দেশ্যে একই স্থানে কোনো ফসল জন্মিয়ে সবুজ গাছগুলোকেব মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়াকেসবুজ সার বলে।জমিতে এই পদ্ধতিতে সবুজ সার ব্যবহারের ইতিহাস স্মরণাতীতকালথেকেই চলে আসছে।রোমানগণ সর্বপ্রথম মিশ জাতীয় শস্য সবুজ সার হিসাবে ব্যবহারকরেছেন।
সবুজ সার জাতীয় গাছরপরিচিতি
শুঁটি এবং অশুঁটি উভয় জাতীয় গাছ দ্বারাই সবুজ সার করাযায়।সবুজ সারের উপযোগী প্রায় ৩০টির মতো শুটি এবং ১০টির মতোঅশুঁটি জাতীয় শস্য রয়েছে।আমাদের দেশে সচরাচর শুঁটি জাতীয় গাছই সবুজ সার হিসাবেব্যবহারের জন্য চাষ করা যায়।এগুলোর মধ্যে ধৈঞ্চা, বরবটি, শণই প্রধান।এ ছারাশিম, খেসারি, মাশকলাই, মুগ, মটর, মসুর, ছোলা, সয়াবীন, চীনাবাদাম, অরহর প্রতৃতিও শুটি জাতীয় শস্য।অশুঁটি জাতীয় গাছেরমধ্যে রয়েছে ভুট্টা, ধান, গম, খোয়ার, ইক্ষু, সূর্যমুখী, বাজরা, তুলা, তামাক প্রভৃতি।
কিভাবে সবুজ সার প্রস্তুতকরবেন
বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী দু্'একটি আদর্শ সবুজ সারজাতীয় ফসালের চাষ ও সবুজ সার প্রস্তুত প্রণারী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করাযাক।
শুঁটি জাতীয় সবুজসার
শুঁটি জাতীয় সবুজ সারের উপযোগী গাছ সারা বছরই চাষ করাযায়, তবেশীতের সময় এর বাড় বাড়তি কম হয়।
ধৈঞ্চা
ধৈঞ্চা বাংলাদেশেরমাটি ও আবহাওয়াতে ভাল জন্মায়।দু-একটি চাষ ও মই দিয়ে ধৈঞ্চার বীজ বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাসে ঘনকরে বুনে দিন।বীজ বোনার আগে শিকড়ের শুঁটির সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যহেক্টরপ্রতি ২০ কেজি বীজ ঘন করে ছিটিয়ে বুনে তা হালকা চাষ দিয়ে বীজগুলো মাটির নিচেফেলে দিন।কোনো প্রকার যত্ন ছাড়াই দেখবেন দু'মাসের মাধ্যে গাছেফুল দেখা দিয়েছে।তখনই গাছ সবুজহ সার তৈরীর উপযুক্ত হয়েছে ধরেনেবেন।গাছ বেশি লম্বা হয়ে গেলে ২/৩ টুকরা করে কেটে নিয়ে ঐক্ষেত্রে মই দিয়ে গাছ মাটির সাথে মিশিয়ে দিন ক্ষেত্রে সামান্য পানি থাকলে ধৈঞ্চা মইদেয়ার পর খুব সহজে কাদামাটির সাথে মিশে যায়।সাধারণত প্রথম চাষ দেয়ার ১০/১২ দিনের মাথায়পুনরায় চাষ ও মই দিন।দেখবেন মোট ১০/১৫ দিনের মাথায় ধৈঞ্চা গাছ মাটির সাথে মিশেগিয়ে সুবজ সারে পরিণত হয়েছে।ধৈঞ্চা সারের পর রোপা আমন ভালো জন্মায়- তাই ধৈঞ্চা চাষের পররোপা আমনের চাষ করুন।
শণ
শণ একটিউৎকৃষ্টসবুজ জাতীয় সার।ধৈঞ্চার অনুরূপ পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি ৪০/৫০ কেজি বীজ ঘন করে উঁচু জমিতে বপনকরুন।শণগাছ দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না।তাই ক্ষেতে নালা রাখুন।গাছ ১.২/১.৫ মিটারউঁচু বা ৭/৮ সপ্তাহ পর ফুল দেখা দিলেই ধৈঞ্চার মতো মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়েদিন।১৫দিন পর আবার মই দিয়ে ক্ষেতের পানির সাথে মিশিয়ে দিন।এমনি গাছ পচে যেতেসময় লাগকেব এক মাস।শণ গাছ পচে গিয়ে মাটিতে উৎকৃষ্টমানেরজৈব সার প্রস্তুত করে।
বরবটি
বরবটিও সবুজ সারহিসাবে চাষ করা যায়।যদিও বরবটি মানুষ ও পশুখাদ্য হিসাবেই বেশি চাষ হয় তথাপিচীনে সবুজ সার হিসাবে চাষে এর ফলন বেশি।
বরবটি উঁচু জমির শস্য।পানি দাঁড়ালে ভাল কখনও হয় না।লাল মাটির জন্যখাড়টি অত্যন্ত উপযুক্ত সবুজ সার।অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল বরবটি গাছে মাত্র ছয় সপ্তাহের মাঝেইফুল আসে এবং তখনই তা সবুজ সার হিসাবে ব্যবহারের উপযুক্ত হয়।ঐ সময় চাষ দিয়েমাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সবুজ সার প্রস্তুত করতে হয়।
জৈব সারেরউপকারিতা
এখন কৃষি ক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে।৬০-এর দশকের আগেএদেশে দেশী জাতের ধান আবাদ হতো।তখন যা উৎপাদন ছিলতাতেই আমাদেরচলে যেত।জনসংখ্যা বাড়ছে, খাদ্যের প্রয়োজন বাড়ছে, তাই ৬০-এর দশক থেকেআস্তে আস্তে শুরু হল সেচ আর রাসায়নিক সার ব্যবহারের।
গত ৩০ বছর থেকে পর্যায়ক্রমে একই জমিতে একই ফসলেরচাষ, রাসায়নিক সার ব্যবহার, জৈব সারের ঘাটতি- সব কিছু মিলে মাটি আজ তারউর্বরা শক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে।আমরা উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ করতে গিয়ে শস্যবেড়ে ওঠার জন্য তার যত্ন নিচ্ছি।খাবার দিচ্ছি এবং পরবর্তীতে তার কাছ থেকে কাঙ্খিত ফলনপাচ্ছি।কিন্তু মাটির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করছিকি?
মাটির খাদ্য হচ্ছে জৈব সার বা জৈব মিশ্রণ।গোবর একটি জনপ্রিয়বহুল প্রচলিত এবং উৎকৃষ্টমানের জৈব সার।জ্বালানি ঘাটতির কারণে মূল্যবান এই সারএখনজ্বালানি কাজে ব্যবহার হয়।ফসল সংগ্রহের পর খড়নাড়া কিংবা মোচা জমিতে রেখেই পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশ্রিত দেয়া হত।পরবর্তীতে সেখানথেকে তৈরী হত মাটির খাদ্য।আজ এগুলো সবই ব্যবহার করা হয় অন্য কাজে।তাহলে মাটির খাদ্যেররইল কি? আমরা যদি গত ৩০ বছর ধরে রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশিজমির জন্য প্রয়েজনীয় পরিমাণজৈব সার ব্যবহারের ধারা অব্যাহত রাখতে পারতাম তবে সম্ভবতবলাযেত যে, আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশের আবাদি জমিগুলো থেকে ফসলউৎপাদনেরমাত্রা বর্তমানের মতোই অব্যঅহত রাখা সম্ভব হবে।কিন্তুএকথা বলার মতো প্রেক্ষাপট আর নেই।বহু দিন ধরেপ্রচেষ্টার পর কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বর্তমান সময়ে এসে আমরা খাদ্যেহয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথে- এটি একটি বিরাট সাফল্য।৫৬ হাজার বর্গমাইলভূমির এই দেশে প্রায় ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যের উৎপাদন চাট্টিখানি কথানয়।উৎপাদন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।শস্যেরসাথে মাটির সমন্বয় মোটামুটি ঠিক থাকলেও এর পরথেকে উৎপাদন হবে নিম্নমূখী।ফসলের এই উৎপাদনেরপ্রক্রিয়াশুরু হয়েছিল ২৫-৩০ বছর আগে যে ফলআমরা ভোগ করছি আজ।আজ যে পরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হবে সেই ফলাফল আসবে আগামীএক দু'দশক পর।কৃষি ক্ষেত্রের এ জাতীয় পরিবর্তন আসতে ২০-২৫ বছর সময় লেগেযায়।
তথ্য সূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষেরচাষবাস’গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত