শুকনো মৌসুমে তীব্র খরা, বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, সেই সঙ্গে ছিল পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ প্রকৃতির নানা বৈরিতা।। প্রায় সব ফসলেরই উৎপাদন বেড়েছে। তবে কৃষকরা বলছেন, ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য সরকার বিলম্বে ঘোষণা করায় এবং বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকায় তাঁরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এর পরও মাঠপর্যায়ে কৃষি উপকরণের জোগান বাড়ায় গত তিন বছরে দেশে কৃষি খাতে সাফল্য এসেছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বছরে চাষ হওয়া অন্তত ৩৮ জাতের কৃষি ফসলের মধ্যে গত তিন অর্থবছরে অধিকাংশেরই ফলন বেড়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকায় কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গত অর্থবছরের বোরো মৌসুমে ৭৪৮ কোটি ৭০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সারের উচ্চমূল্যের কারণে দুই দফায় দাম প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছে। এর ফলে গত দুই অর্থবছরের প্রতি মৌসুমে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বিদ্যুতের ঘাটতির সময়েও সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। কৃষকের দোরগোড়ায় সার পেঁৗছাতে প্রতি ইউনিয়নে পাঁচ থেকে ৯ জন পর্যন্ত খুচরা বিক্রেতা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষকের পাশে ছিলেন। এসবের ফলেই ফসলের উৎপাদন বাড়ে বলে কৃষিমন্ত্রী দাবি করেন।
তবে জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত কৃষক প্রতিনিধি যশোরের আলতাব হোসেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামের কৃষক অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার সিমু, ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল সদর উপজেলার কৃষক মোবারক আলীসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা যায় তাঁদের হতাশার কথা। তাঁরা জানিয়েছেন, গত বোরো মৌসুমে তীব্র কুয়াশায় চারা মরে যায়। ফলে আবার চারা রোপণ করে দেরিতে ধান চাষ করেন কৃষকরা। তারপর পানি সংকট ছিল তীব্র। তাই তাঁদের রাত জেগে জমিতে সেচ দিয়ে তারপর চুরি ঠেকাতে পাহারা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের ডিজেল কিনতে হয় পাম্প ও দোকানে লাইন দিয়ে, সরকার নির্ধারিত ৪৪ টাকার বদলে প্রতি লিটারে পাঁচ-সাত টাকা বেশি দরে। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ, চারা, সার, কীটনাশকসহ সব উপকরণে বাড়তি খরচ করতে গিয়ে অনেককেই ঋণ করতে হয়। ঋণ পরিশোধ করতে তাঁরা মাঠ থেকে মাড়াই করা ধান সরকার নির্ধারিত দামের মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কৃষকরা আরো জানান, তিন বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন তেমন ঘটেনি। সরকারের সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় 'লাভ টিয়ায় খেয়ে যাচ্ছে'।
দেশের কৃষকদের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক (গবেষণা) ড. এম এ ছালাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষির প্রতি সরকারের তুলনামূলক বেশি ইতিবাচক ভূমিকা, ফসলের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা উপকরণ সহায়তা, ফসলব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কৃষকের সচেতন হওয়াসহ কিছু বিষয় এতে ভূমিকা রাখে। গত বোরো মৌসুমের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. ছালাম বলেন, ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের দুর্দশা ছিল অবর্ণনীয়। সেচ, বীজ ও চারার সংকটের পাশাপাশি কুয়াশায় অসংখ্য বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। চলতি আমন মৌসুমেও কৃষক নানা সংকটের আবর্তে রয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বিলম্বে নির্ধারণের অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ধান চাষে খরচ ও লাভ হিসাব করে সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। আর ধান ওঠার সময়টায় বেশি 'ময়েশ্চার' (আর্দ্রতা) থাকে, যা গুদামজাতের জন্য উৎকৃষ্ট হয় না। গুদামজাতের জন্য উপযুক্ত ময়েশ্চার ধানে এলেই দাম ঘোষণা করা হয়। এতে কৃষকের তেমন আর্থিক ক্ষতি হয় না দাবি করে মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য আরো আগে (ধান ওঠার সময়ই) নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. জহুরুল করিম ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) জাতীয় উপদেষ্টা কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলামও মনে করেন, ফসল উৎপাদন বাড়লেও বেশি তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। তাঁরা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি খাতকে ক্রমেই বিপন্ন করে তুলছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার প্রভাব তীব্র হচ্ছে। আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এ দুই কৃষি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সব ধরনের ফসল চাষেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করতে সরকারকেই সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষকদের শারীরিক শ্রমে অর্জিত ফসল দেশবাসীর খাদ্যের জোগান দেয়। এ ফসলের ন্যায্যমূল্যই যদি না জোটে, চাষে আগ্রহ হারাবে কৃষক। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারও।
সিপিডির গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. উত্তম কুমার দেব বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়াও অনেক সময় ফসলের অনুকূলে আসায় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও কৃষকের যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল বলে তিনি জানান। ড. উত্তম কুমার দেব মনে করেন, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে ফসলের খরচ ও লাভ উল্লেখ করে সঠিক সময়ে ক্রয়মূল্য নির্ধারণে সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে।
বাংলাদেশ সিড গ্রোয়ার, ডিলার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব আনাম বলেন, ২০০৯ সালের বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষের পরিমাণ (প্রায় আট লাখ হেক্টর) বাড়লেও উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য দিতে না পারায় ২০১০ সালের তা কমে পাঁচ লাখ হেক্টরে নেমেছে। তবে উচ্চ ফলনশীল বেশ কয়েকটি জাত চাষে উৎপাদন তুলনামূলক ভালো হয়েছে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে ৮০ টাকা কেজির সার মাত্র ২০-৩০ টাকায় কৃষককে দিয়েছে। টিএসপি, এমওপি, ডিএপিসহ ইউরিয়া সারের দাম সাধ্যের মধ্যে থাকায় ফসলে 'সারের সুষম' ব্যবহার হয়েছে। ফলে উৎপাদনও বাড়ছে। আগের বছরগুলোতে দু-একটি সারের উচ্চমূল্যের কারণে ফসলে সারের ব্যবহার 'সুষম' হয়নি। ফলে ধানে চিটাসহ নানা ধরনের রোগ লেগেই থাকত। উৎপাদনও আশানুরূপ হতো না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বীজ শাখার মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক দাবি করেছেন, মানসম্মত বীজের সরবরাহ বাড়ার ফলেই ফলন বেড়েছে। আগে মোট বীজের চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ পূরণ করত সরকার; এখন তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ধানবীজের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশের স্থলে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশের কৃষকের মাঝে মানসম্মত বীজ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারলে ফসলের উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব।
বৈরী পরিবেশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানির স্তর নেমে যাওয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একাধিক গবেষণা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমেছে। এর মধ্যে মোট ধানের ৩৬ শতাংশ জোগান দেওয়া উত্তরাঞ্চল রয়েছে স্পর্শকাতর অবস্থায়। দেশের সমতল ভূমির তুলনায় উত্তরাঞ্চলের ভূমি স্থানবিশেষে ১২ থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু। ফলে শুষ্ক মৌসুমের আগেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে নদ-নদী, পুকুর ও জলাশয়। পানির স্তর গভীরে চলে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমের আগেই সেচ পাম্পগুলোও হারিয়ে ফেলে পানি উত্তোলনের ক্ষমতা। গবেষণায় বলা হয়, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমিতে ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ভূগর্ভের ৬২ ফুটের মধ্যে। ২০০০ সালে ৪৮ ফুট নিচে গিয়ে ১১০ ফুটে দাঁড়ায়। এখন এ স্তর স্থানভেদে ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকায় কৃষককে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গত অর্থবছরের বোরো মৌসুমে ৭৪৮ কোটি ৭০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সারের উচ্চমূল্যের কারণে দুই দফায় দাম প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছে। এর ফলে গত দুই অর্থবছরের প্রতি মৌসুমে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বিদ্যুতের ঘাটতির সময়েও সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। কৃষকের দোরগোড়ায় সার পেঁৗছাতে প্রতি ইউনিয়নে পাঁচ থেকে ৯ জন পর্যন্ত খুচরা বিক্রেতা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষকের পাশে ছিলেন। এসবের ফলেই ফসলের উৎপাদন বাড়ে বলে কৃষিমন্ত্রী দাবি করেন।
তবে জাতীয় বীজ বোর্ডের তালিকাভুক্ত কৃষক প্রতিনিধি যশোরের আলতাব হোসেন, নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামের কৃষক অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার সিমু, ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল সদর উপজেলার কৃষক মোবারক আলীসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা যায় তাঁদের হতাশার কথা। তাঁরা জানিয়েছেন, গত বোরো মৌসুমে তীব্র কুয়াশায় চারা মরে যায়। ফলে আবার চারা রোপণ করে দেরিতে ধান চাষ করেন কৃষকরা। তারপর পানি সংকট ছিল তীব্র। তাই তাঁদের রাত জেগে জমিতে সেচ দিয়ে তারপর চুরি ঠেকাতে পাহারা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের ডিজেল কিনতে হয় পাম্প ও দোকানে লাইন দিয়ে, সরকার নির্ধারিত ৪৪ টাকার বদলে প্রতি লিটারে পাঁচ-সাত টাকা বেশি দরে। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ, চারা, সার, কীটনাশকসহ সব উপকরণে বাড়তি খরচ করতে গিয়ে অনেককেই ঋণ করতে হয়। ঋণ পরিশোধ করতে তাঁরা মাঠ থেকে মাড়াই করা ধান সরকার নির্ধারিত দামের মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কৃষকরা আরো জানান, তিন বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন তেমন ঘটেনি। সরকারের সরাসরি বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় 'লাভ টিয়ায় খেয়ে যাচ্ছে'।
দেশের কৃষকদের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক (গবেষণা) ড. এম এ ছালাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষির প্রতি সরকারের তুলনামূলক বেশি ইতিবাচক ভূমিকা, ফসলের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানা উপকরণ সহায়তা, ফসলব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কৃষকের সচেতন হওয়াসহ কিছু বিষয় এতে ভূমিকা রাখে। গত বোরো মৌসুমের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. ছালাম বলেন, ফসলের উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের দুর্দশা ছিল অবর্ণনীয়। সেচ, বীজ ও চারার সংকটের পাশাপাশি কুয়াশায় অসংখ্য বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। চলতি আমন মৌসুমেও কৃষক নানা সংকটের আবর্তে রয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বিলম্বে নির্ধারণের অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ধান চাষে খরচ ও লাভ হিসাব করে সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হয়। আর ধান ওঠার সময়টায় বেশি 'ময়েশ্চার' (আর্দ্রতা) থাকে, যা গুদামজাতের জন্য উৎকৃষ্ট হয় না। গুদামজাতের জন্য উপযুক্ত ময়েশ্চার ধানে এলেই দাম ঘোষণা করা হয়। এতে কৃষকের তেমন আর্থিক ক্ষতি হয় না দাবি করে মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য আরো আগে (ধান ওঠার সময়ই) নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. জহুরুল করিম ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) জাতীয় উপদেষ্টা কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলামও মনে করেন, ফসল উৎপাদন বাড়লেও বেশি তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। তাঁরা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি খাতকে ক্রমেই বিপন্ন করে তুলছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার প্রভাব তীব্র হচ্ছে। আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এ দুই কৃষি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সব ধরনের ফসল চাষেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করতে সরকারকেই সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষকদের শারীরিক শ্রমে অর্জিত ফসল দেশবাসীর খাদ্যের জোগান দেয়। এ ফসলের ন্যায্যমূল্যই যদি না জোটে, চাষে আগ্রহ হারাবে কৃষক। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারও।
সিপিডির গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. উত্তম কুমার দেব বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়াও অনেক সময় ফসলের অনুকূলে আসায় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও কৃষকের যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল বলে তিনি জানান। ড. উত্তম কুমার দেব মনে করেন, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে ফসলের খরচ ও লাভ উল্লেখ করে সঠিক সময়ে ক্রয়মূল্য নির্ধারণে সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে।
বাংলাদেশ সিড গ্রোয়ার, ডিলার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব আনাম বলেন, ২০০৯ সালের বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষের পরিমাণ (প্রায় আট লাখ হেক্টর) বাড়লেও উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য দিতে না পারায় ২০১০ সালের তা কমে পাঁচ লাখ হেক্টরে নেমেছে। তবে উচ্চ ফলনশীল বেশ কয়েকটি জাত চাষে উৎপাদন তুলনামূলক ভালো হয়েছে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে ৮০ টাকা কেজির সার মাত্র ২০-৩০ টাকায় কৃষককে দিয়েছে। টিএসপি, এমওপি, ডিএপিসহ ইউরিয়া সারের দাম সাধ্যের মধ্যে থাকায় ফসলে 'সারের সুষম' ব্যবহার হয়েছে। ফলে উৎপাদনও বাড়ছে। আগের বছরগুলোতে দু-একটি সারের উচ্চমূল্যের কারণে ফসলে সারের ব্যবহার 'সুষম' হয়নি। ফলে ধানে চিটাসহ নানা ধরনের রোগ লেগেই থাকত। উৎপাদনও আশানুরূপ হতো না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বীজ শাখার মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক দাবি করেছেন, মানসম্মত বীজের সরবরাহ বাড়ার ফলেই ফলন বেড়েছে। আগে মোট বীজের চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ পূরণ করত সরকার; এখন তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ধানবীজের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশের স্থলে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশের কৃষকের মাঝে মানসম্মত বীজ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারলে ফসলের উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব।
বৈরী পরিবেশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানির স্তর নেমে যাওয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একাধিক গবেষণা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমেছে। এর মধ্যে মোট ধানের ৩৬ শতাংশ জোগান দেওয়া উত্তরাঞ্চল রয়েছে স্পর্শকাতর অবস্থায়। দেশের সমতল ভূমির তুলনায় উত্তরাঞ্চলের ভূমি স্থানবিশেষে ১২ থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু। ফলে শুষ্ক মৌসুমের আগেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে নদ-নদী, পুকুর ও জলাশয়। পানির স্তর গভীরে চলে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমের আগেই সেচ পাম্পগুলোও হারিয়ে ফেলে পানি উত্তোলনের ক্ষমতা। গবেষণায় বলা হয়, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমিতে ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ভূগর্ভের ৬২ ফুটের মধ্যে। ২০০০ সালে ৪৮ ফুট নিচে গিয়ে ১১০ ফুটে দাঁড়ায়। এখন এ স্তর স্থানভেদে ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ