কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

Monday, August 2, 2010


শাইখ সিরাজ

ইউরিয়া ছাড়া তিনটি সারের দাম অর্ধেক কমেছে। সারের দাম কমার এই হার সত্যিই এক বিরল ঘটনা বটে। আসন্ন বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে নতুন নির্বাচিত সরকারের এ এক যুগান্তôকারী পদক্ষেপ। গত ১৪ জানুয়ারি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও শিল্পমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দিয়ে সত্যিই দেশের কৃষকের পুঞ্জিভূত প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। তবে এখানেই শেষ নয়, সময়মতো সারের যোগান নিশ্চিত করা এবং কৃষকের অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা অনুকূলে থাকলে কৃষক একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। ইউরিয়া ব্যতিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সার টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের দাম অর্ধেক কমানোর পেছনে মূল লক্ষ হচ্ছে বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা। কৃষক যদি কম মূল্যে সার কিনতে পারে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারবে, সে ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় মূল্যও থাকবে কম। যার প্রভাব থাকবে ভোক্তা পর্যায়ের খুচরা বাজার পর্যন্ত। সারের দাম কমানোর ঠিক দুদিন আগেই সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২ টাকা কমিয়ে তাৎক্ষণিক একটি চমক দিয়েছে বটে, কিন্তু এর প্রভাব কৃষক পর্যায়ে পড়বে না।

২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইউরিয়া ছাড়া বাকি তিন ধরণের সারে সরকারের ভর্তূকি হার ছিল ২৫ শতাংশ, আর ঠিক এই অর্ধেক মূল্য কমানোর আগে সরকারের ভর্তূকির হার ছিল ১৫ শতাংশ। আর এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ভর্তূকি দিচ্ছে ৫৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২ হাজার ৭’শ ৫৭ কোটি টাকা। এই ভর্তূকির সুফল কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্যও সরকার দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে বলে ঘোষণা এসেছে। এই প্রক্রিয়ায় সফলতা অর্জন করলে তা কৃষকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ঘোচাবে বলেই বিশ্বাস করছি। কারণ গত ছয় বছর যাবৎ জাতীয় বাজেটের আগে কৃষকদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে পেয়েছি তা হচ্ছে কৃষকদের তথ্য প্রাপ্তির অভাব। অর্থাৎ কৃষক জানেন না যে, সার কিংবা সেচ বাবদ সরকারের তরফ থেকে কত ভর্তূকি দেয়া হয়, কীভাবে দেয়া হয়? সার তারা কেনেন ভর্তূকি দরে, কিন্তু এই তথ্যটুকু না জানার কারণে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কিংবা সরকারের দায়িত্বের জায়গাটি অস্পষ্টই থেকে যায়। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি সেচখাতে ডিজেল কিংবা বিদ্যুতে সরকারের যে ভর্তূকি ও রেয়াত সুবিধা দেয়া হয় তা সেচ পাম্প মালিক পর্যন্তô পৌঁছে। কৃষক মূল্য পরিশোধের বেলায় ভর্তূকি সুবিধার কিছুই পান না। এই কারণে কৃষির সকল স্তôরে বছরব্যাপী কৃষকদের বঞ্চনার পাল্লা ভারী হতেই থাকে। এবার সরকার ভর্তূকির সুফল যদি চুলচেরা হিসাবে কৃষকের ঘরে পৌঁছে দিতে পারে তা হবে অনেক বড় একটি অর্জন।

গত দুই বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে সারের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কৃষক বারবারই এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ২০০৭ সালের শেষের দিকে সিডর-এর মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার আগে দুইবারের বন্যা এত কিছুর পর খাদ্যশস্যের ঘাটতি পূরণের এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সারের চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে কৃষককে। তারপরও কৃষক নিশ্চিত করেছে বাম্পার ফলন। এটি সত্যিই এক বড় ঘটনা। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, গত দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কৃষকের খুব কাছাকাছি থেকে ফসলের বেশি উৎপাদনের লক্ষে যথেষ্ট আন্তôরিকতা দেখিয়েছে, কিন্তু সারের মূল্য কমাতে পারেনি তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে হয়তো এমন একটি সিদ্ধান্তô গ্রহণ তাদের কাছে সহজ ছিল না। এই সময়েও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে সরকারের আনুকূল্য নিয়ে রাজনৈতিক কোন বিতর্ক ছিল না, এটিও এদেশের জন্য অত্যন্তô ইতিবাচক দিক। হয়তো সে কারণেই অনেক প্রতিকূল অবস্থার ভেতরও সরকারের আন্তôরিকতাকে তারা কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে। গত এক দেড় বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সারের চড়ামূল্যের কারণে কৃষককে সত্যিই এক দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়েছে। আলু চাষের সমৃদ্ধ ক্ষেত্র রাজশাহী ও রংপুরের অনেক কৃষককে আলু রোপণ মৌসুমে ফলন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ার চিত্র যেমন দেখেছি, একইভাবে দেখেছি মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে শুধু সারের চড়া মূল্যের কারণে আলু চাষ থেকে অনেক কৃষককে সরে গিয়ে ক্ষতিকর তামাক চাষের দিকে ঝুঁকতে। কারণ, তামাক চাষের ক্ষেত্রে কৃষকের সারের নিশ্চতয়তা আছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে (সারের মূল্য কমানোর ঠিক দুই দিন আগে) চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, যে এলাকাগুলো কৃষিতে দারুণ সমৃদ্ধ সেখানেও বিরাজ করছে এক হতাশা।

সীতাকুণ্ডের ধর্মপুর গ্রামের কৃষক মানিক চন্দ্র নাথ বলছিলেন, প্রয়োজনমাফিক টিএসপি প্রয়োগ করা হলে যে সীমের ডগায় ১৫ থেকে ২০টি করে সীম ধরতো, সার প্রয়োগ না করার কারণে সেখানে সীম এসেছে ৮ থেকে ৯টি। টিএসপি প্রয়োগ না করতে পেরে উৎপাদনের এই দশা। এই পরিস্থিতি দেশের সব এলাকার। সবাই তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে সারের মূল্য কমানোর কথা। দিন দশেক আগে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার এক গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা স্পষ্টতই বলেছেন- সারের মূল্য কমালে চালের দাম কমানো যাবে। এমন চিন্তা দেশের সব এলাকার কৃষকের। সত্যিই কৃষকের এই চিন্তôাই মূল্যায়িত হয়েছে তিন ধরণের সারের মূল্য অর্ধেক কমানোর সিদ্ধান্তে। বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে সরকারের এই ঘোষণার পরিপূর্ণ সাফল্য আসবে ইউরিয়ার পরিপূর্ণ যোগান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। আবহাওয়া ও প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে আর ইউরিয়ার যোগান নিশ্চিত করা গেলে বোরোতেও আরও একটি বড় উৎপাদন সাফল্য আসবে বলে আশা করি। আজ সারের মূল্য কমানোর বিষয়টিকে যদি সরকারি বিনিয়োগও ধরা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিন মাসের মধ্যেই লভ্যাংশসহ তা ফেরত পাওয়া যাবে। দূরদর্শী সিদ্ধান্তô গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী তথা কৃষিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীকে জানাই আন্তôরিক ধন্যবাদ।

তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত

মনের উঠোনে

সাম্প্রতিক সংযোজন

মোবাইল থেকে দেখুন

আমাদের দেশ এখন আপনার মুঠোফোনে, মোবাইল থেকে লগইন করুন আমাদের দেশ

দ র্শ না র্থী

দ র্শ না র্থী

free counters

কে কে অনলাইনে আছেন