সারা দেশে এখন বোরো ধানের চারা রোপণ চলছে। কেউ কেউ নিচু জমিতে জমে থাকা প্রাকৃতিক পানির সদ্ব্যবহার করতে একটু আগেই চারা রোপণের কাজ শুরু করেছেন। আবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে চারা রোপণ হবে একটু পরে। তবে অনেক সময়ই চারা রোপণের পর বোরোচাষিরা গাছ আশানুরূপভাবে বেড়ে না ওঠার সমস্যার কথা বলেন। কেউ কেউ বোরো ধানের ক্ষেতে বেশি রোগ ও পোকা আক্রমণের সমস্যায় ভোগেন। আসলে সঠিকভাবে বীজতলা বা পাতাখোলা থেকে বোরো ধানের চারা না তুলতে পারলে এবং সঠিক পদ্ধতিতে তা রোপণ করতে না পারলে এসব সমস্যা দেখা দেয়। সার দিয়েও জমির গাছ বড় করে তোলা যায় না এবং বিভিন্ন বালাইয়ের আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়। তাই গোড়ায় গলদ না রেখে চারা রোপণের সময়ই বোরোচাষিরা একটু সতর্ক হয়ে সঠিক পদ্ধতিতে চারা তুললে ও রোপণ করলে ভালো ফসল পেতে পারেন। আসুন, চারা তোলা ও রোপণের সেই সঠিক পদ্ধতিগুলো জেনে নেয়া যাক।
চারা তোলা: বীজতলা থেকে চারা তোলার আগে বীজতলা শুকনো থাকলে তা পানি দিয়ে একরাত ভিজিয়ে রাখতে হবে।বীজতলা থেকে চারা সাবধানে তুলতে হবে। তোলার সময় লক্ষ রাখতে হবে যাতে চারার গোড়া ছিঁড়ে না যায় বা শিকড় কম ছেঁড়ে। এসব ক্ষতের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া জীবাণু জমিতে থাকলে সুস্খ চারায় তার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং পরে তা ক্ষেতের গাছে পাতাপোড়া রোগ সৃষ্টি করে। চারা তোলার পর পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করে গোড়ার মাটি ছাড়ানো ঠিক নয়, এতে চারার ঘাড় ভেঙে যেতে পারে। পরে এসব চারা জমিতে রোপণ করলে মরে যেতে পারে বা আঘাত সেরে উঠে জমিতে রোপণ করতে বেশি দিন লাগতে পারে।
চারা মজুদ ও স্খানান্তর : চারা বীজতলা থেকে তোলার পর দুই দিনের মধ্যেই রোপণ করতে হবে। কোনো কারণে চারা রেখে দিতে হলে চারার গোড়া পানির মধ্যে চুবিয়ে রেখে দিতে হবে। চারা কখনো বস্তায় ভরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া ও রাখা উচিত নয়। ঝুড়িতে নিতে হবে ও খোলা জায়গায় ছায়ায় রাখতে হবে।
চারা বাছাই ও শোধন: চারা তোলার পর রোপণের আগে তা থেকে রোগগ্রস্ত ও পোকায় আক্রান্ত চারা বেছে বাদ দিতে হবে। সম্ভব হলে চারা রোপণের আগে প্রতি লিটার পানিতে এক গ্রাম ব্যাভিস্টিন ছত্রাকনাশক গুলে সেই পানিতে ১০ মিনিট চারার গোড়া বা শিকড় ভিজিয়ে রেখে জমিতে রোপণ করতে হবে। এতে চারা তোলার সময় যদি তাতে কোনো জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে তবে সেগুলো নষ্ট হবে।
জমি তৈরি : চারা রোপণের আগে অবশ্যই জমি ভালো করে চাষ দিয়ে কাদা করতে হবে ও আইল বাঁধতে হবে। চাষের সময় অনুমোদিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার (ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সার) শেষ চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। জমি চাষের পর তা সমতল করে অল্প পানি (২-৩ ইঞ্চি) আটকে রাখতে হবে। যে দিন চারা রোপণ করা হবে ঠিক তার আগের দিন জমি চাষ দিয়ে সমতল করা ভালো। এতে নরম হয়ে যাওয়া মাটি একটু থিতিয়ে যায়। ফলে রোপণ করা চারা সহজে হেলে পড়ে না বা রোপণের পর উঠে আসে না। তবে বেলে মাটিতে দিনে দিনেই চাষ দিয়ে চারা রোপণ করতে হবে, না হলে মাটি শক্ত হয়ে যাবে এবং সে জমিতে চারা রোপণ করতে অসুবিধা হবে।
রোপণ উপযোগী চারার বৈশিষ্ট্য: রোপণের জন্য চার-পাঁচটি পাতাযুক্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। সঠিক বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। চারার বয়স হবে হাইব্রিড জাতের বেলায় ২০-২২ দিন, মাঝারি জীবনকালের জাতের বেলায় ২৫-৩০ দিন এবং দীর্ঘ জীবনকালের বা নাবি জাতের চারার বেলায় ৩৫-৪০ দিন। কোনো কারণে চারার বয়স বেশি হলে আঁটি ধরে চারার মাথা বা আগা থেকে কিছুটা পাতা ছিঁড়ে ফেলে রোপণ করতে হবে।
চারা রোপণ: প্রতি গুছিতে দুই থেকে তিনটি চারা রোপণ করা উচিত। এতে এক দিকে বীজের যেমন সাশ্রয় হয় তেমনি গাছে কুশিও ভালো গজায়। মাটির ২ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার (১-১.৫ ইঞ্চি) গভীরে চারা রোপণ করা উচিত। বেশি গভীরে চারা পুঁতলে মাটিতে লাগতে ও কুশি ছাড়তে দেরি হয় এবং বাড়তি কমে যায়।
রোপণ দূরত্ব: হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার দিতে হবে। অন্যান্য আধুনিক জাতের ক্ষেত্রে সব দিকে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্ব দিলেই চলে। স্বল্প জীবনকালের জাতের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার থেকে ২০ সেন্টিমিটার দেয়া যেতে পারে। চারা রোপণের পর জমিতে অবশ্যই ছিপছিপে পানি রাখতে হবে।
ফাঁকা জায়গা পূরণ: রোপণের পর কিছু চারা মরে যেতে পারে। সে জন্য রোপণের সময় জমির এক কোণে কয়েক গুছি চারা পুঁতে রাখতে হবে, যাতে পরে সেসব চারা থেকে ফাঁকা জায়গায় আবার চারা লাগানো যায়। এতে চারার বয়স ঠিক থাকে। ফলে গাছের বাড়তি ও ফলন হয় প্রায় একই রকম।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্রঃ এগ্রোবাংলা