সাধারনভাবে একটি গাছ থেকে আরেকটি নতুন গাছের জন্ম হওয়ার পদ্ধতিকে গাছের বংশবিস্তার বলে। অন্য কথায় যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ যৌন কোষ বা তার অংগজ কোষ থেকে নতুন স্বতন্ত্র গাছ সৃষ্টি করে তাকে বংশবিস্তার বলে। বংশ বিস্তার সাধারনত ২ ধরনের হয়ে থাকে যথা-
১। যৌন বংশবিস্তার
২। অযৌন বংশ বিস্তার
যেহেতু ফল গাছ রোপণের মূল উদ্দেশ্য হলো ভালো, উন্নতমান ও মাতৃ গাছের গুনাগুন সম্পন্ন ফল পাওয়া। এ কারণে ফল গাছের ক্ষেত্রে যৌন পদ্ধতির তুলনায় অযৌন পদ্ধতির চার, কলম অধিক গুরুত্বপূর্ন। অযৌন বংশবিস্তার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ক্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল জোড় কলম একটি অন্যতম পদ্ধতি।
২। আমের জোড় কলম করার উপায়
প্রধানত জোড় কলম দুই ধরনের হয়ে থাকে যেমন :
- সংযুক্ত জোড় কলম; সায়ন মাতৃগাছ হতে না কেটে রুটস্টকের সাথে জোড়া লাগানো হয়ে থাকে।
- বিযুক্ত জোড় কলম; সায়ন মাতৃগাছ হতে কেটে এনে রুটস্টকের সাথে জোড়া লাগানো হয়ে থাকে।
৩। সংযুক্ত জোড় কলম
সংযুক্ত জোড় কলমের ভিতরে সংস্পর্শ জোড় (Contact grafting) কলমই প্রচলিত আছে। এটি সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি। যদিও এই পদ্ধতিতে সফলতার হার বেশি তবু তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও বেশি পরিশ্রম লাগে বলে বর্তমানে সাধারণত এই পদ্ধতির চর্চা করা হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযুক্ত কলম বাঞ্ছনীয়। যেমন, পেয়ারা বা রাম্বুটানের বিযুক্ত জোড় কলমের হার একেবারেই কম, কাজেই উইল্ট প্রতিরোধী জাতের সংগে কাঙ্ক্ষিত জাতের জোড় কলম করা হয় বেশি সফলতার পাওয়ার জন্য। সংযুক্ত জোড় কলমের পদ্ধতিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।
৩.১ সংস্পর্শ জোড় কলম (Contact grafting)
৩.২ ভিনিয়ার গ্রাফটিং (Veneer grafting)
৩.১ সংস্পর্শ জোড় কলম (Contact grafting) এর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দিকগুলি
৩.১.১ রুটস্টক নির্বাচনঃ
- সাধারণত ১ বৎসর বয়সের চারা নেওয়া হয়। তবে রুটস্টকের ব্যাস সায়নের মত হওয়া বাঞ্ছনীয়
- রুটস্টক অবশ্যই পলিব্যাগ অথবা মাটির পাত্রে হতে হবে
- রুটস্টক রোগ বালাইমুক্ত, সতেজ, সবল হতে হবে
৩.১.২ সায়ন নির্বাচনঃ
কাঙ্ক্ষিত মাতৃগাছের সুস্থ, সবল ও চলতি মৌসুমের ডাল নির্বাচন করতে হবে। সায়ন, রুটস্টকের ব্যাসের সমান হওয়া ভাল।
৩.১.৩ সময়ঃ গ্রীষ্ম-বর্ষাকাল (বৈশাখ-আষাঢ়)
৩.১.৪ সায়ন প্রস্তুতকরণঃ
v প্রথমে সায়নের হালকা সবুজ ও ধুসরের মিশ্রণ স্থলে এক তৃতীয়াংশ কাঠসহ ৫-৭ সে. মি. এর মত বাকল তুলে ফেলতে হবে।
v এর পর রুটস্টকের তেজদীপ্ত (সবুজ ও ধুসরের মিশ্রণ স্থলে) জায়গায় এবং ১-২ তৃতীয়াংশ কাঠসহ সায়নের কাটা অংশ সমপরিমাণ বাকল তুলে ফেলতে হবে।
v এর পর রুটস্টক ও সায়নের কর্তিত অংশ দুটি পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগাতে হবে।
v দড়ি বা সুতলী দিয়ে জোড়াকৃত অংশ এমন করে বাধতে হবে যাতে জোড়ার মাঝে কোন ফাঁক না থাকে।
৩.১.৫ সতর্কতাঃ
v রুটস্টক নতুন কুশি বের হলে ভেঙ্গে দিতে হবে।
v রুটস্টকের পলিব্যাগ বা পাত্রে সার্বক্ষণিক ভেজা বা রস থাকতে হবে।
v রুটস্টক বা সায়ন জোড়া লাগলে মাতৃগাছ হতে ধারালো চাকু দিয়ে এক অথবা ২-৩ বারে কেটে নামিয়ে আনতে হবে।
v কলমটি কিছুদিন ছায়াতে রেখে দিতে হবে।
v ২-৩ মাস পর রুটস্টকের উপরের অংশ কেটে দিতে হবে।
৩.২ ভিনিয়ার গ্রাফটিং (Veneer grafting)
সংযুক্ত জোড় কলমের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ভিনিয়ার পদ্ধতির কলম প্রচলন আসে। বর্তমানে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই আমের কলম ভিনিয়ার পদ্ধতিতে করা হয়। এই পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত জাতের গাছ থেকে সায়ন কেটে নিয়ে এসে রুটস্টকের সাথে বিশেষ পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হয়।
৩.২.১ সময়ঃ ভিনিয়ারের উপযুক্ত সময় বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ তবে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত করা যাবে।
৩.২.২ ফলঃ আম, পেয়ারা, লেবু, কুল ইত্যাদি।
৩.২.৩ সায়ন এর বৈশিষ্টসমূহঃ
ভিনিয়ার গ্রাফটিং এর জন্যও একই ধরনের সায়ন অর্থাৎ-
(ক) সতেজ, সবল, সুস্থ, চলতি মৌসুমের ডাল নিতে হবে।
(খ) রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে।
(গ) সায়ন অবশ্যই পরিপক্ক হতে হবে।
(ঘ) সায়ন শাখায় কুঁড়ি ঠিক ফোটা ফোটা অবস্থায় নিতে হবে।
(ঙ) সায়ন সাধারণত ৪-৬ ইঞ্চি হলে ভাল হয়।
৩.২.৪ রুটস্টক প্রস্ত্ততিঃ
ছয় থেকে বার মাস বয়সের রুটস্টক উত্তম। রুটস্টক অবশ্যই সতেব, সবল, রোগা ও পোকামাকড়মুক্ত হতে হবে। ম্যালফরমেশনযুক্ত রুটস্টক কখনও নেওয়া উচিত হবে না।
প্রথমে রুটস্টকের উপযুক্ত স্থানে অর্থাৎ-
v যেখানে খয়েরী ও সবুজ রং এর মিশ্রণ ঘটেছে (তবে জোড়ার অংশ মাটির যত নিকটবর্তী হবে ততই ভাল) নির্দিষ্ট করতে হবে।
v উক্ত জায়গায় প্রথমে ব্যাসের এক চতুর্থাংশ তেরছা করে ৩-৪ সে.মি. জায়গায় বাকলসহ কাঠ কেটে উঠাতে হবে।
v পরবর্তীতে উক্ত কর্তিত অংশের নিচে একটি বিপরীতমুখী কাটা দিতে হবে।
৩.২.৫ সায়ন প্রস্ত্ততিঃ
v অনুরুপভাবে সায়নের নিচের অংশে একটি ৩-৪ সে. মি. তেরছা কাটা দিতে হবে এবং এর বিপরীতে একটি কাটা দিতে হবে।
v সায়নের সমস্ত পাতা একটু বোঁটা রেখে কেটে ফেলতে হবে।
v এখন সায়ন রুটস্টকের উপর এমন ভাবে বসাতে হবে যেন একটি অপরটির উপর মিশে যায়।
v এরপর জোড়া লাগানো অংশ পলিথিন টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে।
v এখন সম্পূর্ণ জোড়া লাগানো অংশ সায়নসহ পলিথিন দিয়ে ঢেকে চিকন দড়ি বা সুতলির সাহায্যে সহজ গিরা দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন প্রয়োজনের সময় সহজে পলিথিন খুলে পলিথিনের মধ্যে জমা থাকা পানি বের করে দেয়া যায়।
v ৩০-৬০ দিন পর যখন সায়নের অগ্রভাগের পাতা হালকা সবুজাভ হবে তখন পলিথিনের আবরণ খুলে দিতে হবে এবং যখন সায়ন পুনরায় পাতা দেওয়া শুরু করবে তখন রুটস্টকের উপরের অংশ কেটে দিতে হবে।
v ৬-৭ মাস পরে জোড়া লাগানো অংশ যখন সম্পূর্ণ লেগে যাবে তখন ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে পলিথিনের বাঁধন সরিয়ে ফেলতে হবে।
৪। সংস্পর্শ ও জোড় কলমের পর এখন কোন পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে
হ্যাঁ সংস্পর্শ ও জোড় কলমের পর এখন ক্লেফট গ্রাফটিং (Cleft Grafting)এর প্রচলন জনপ্রিয় হচ্ছে।। এই গ্রাফটিং সহজ এবং রুটস্টকের যে কোন বয়সে করা সম্ভব। এ বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে বর্তমানে নার্সারী পর্যায়ে এর প্রচলন কম। অনেক সময় বাজারে ক্লেফট গ্রাফটিং এর চারা বাজারে বিক্রয় করতে অসুবিধায় পড়েন কারণ এই গ্রাফটিং এ জোড়া অংশ এমন সুন্দরভাবে মিলিয়ে যায় যে ক্রেতারা চারাটি কলমের কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবু্ও উত্তম বংশবিস্তার পদ্ধতি হিসেবে এখন থেকে ক্লেফট গ্রাফটিং এর প্রচলন বাড়ানো জরুরী।
৪.১ সময়ঃ
উপযুক্ত পরিবেশ ও সঠিক বয়সের সায়ন পেলে সার বৎসর ক্লেফট গ্রাফটিং করা যাবে। তবি উত্তম সময় এপ্রিল-জুন মাস। তবে সেচ ও ছায়ার ব্যবস্থা করা গেলে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসেও করা যাবে।
৪.২ রুটস্টক ও সায়ন নির্বাচনঃ
রুটস্টকের বয়স বিশেষ করে আমের ক্ষেত্রে যে কোন বয়সের হতে পারে, তবে ১ বৎসর বয়সের রুটস্টকে কলম বেশি করা হয়। সায়নের বয়স পরিপুষ্ট হতে হবে। চলতি মৌসুমের ডালের পাতাগুলো যখন গাঢ় সবুজ হবে, ডালের ডগায় কুঁড়ি স্ফীত বা ফোটা ফোটা ভাব হবে এবং রোগ বালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ মুক্ত হবে, তখন ঐ ডালকে উপযুক্ত সায়ন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে।
৪.৩ রুটস্টক ও সায়ন প্রস্ত্ততকরণ (১-২ বৎসর বয়সের ক্ষেত্রে)
v সতেজ, সবল, সুস্থ রুটস্টক নিতে হবে।
v মূল ও কান্ডের সংযোগস্থলের যথাসম্ভব কাছাকাছি কান্ডের সবুজ ও খয়েরী রং এর মিশ্রণ স্থানে রুটস্টকের মাথা কেটে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাটা জায়গার নিচে যাতে অবশ্যই কিছু পাতা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
v কাটা মাথার মাঝ বরাবর পরে ধারালো চাকু দিয়ে আনুমানিক ৩-৪ সে.মি. পর্যন্ত চিরে দুভাগ করতে হবে।
v পরিপুষ্ট সায়নের সমস্ত পাতা বোটা রেখে কেটে ফেলতে হবে।
v এরপর সায়নের গোড়ার দিকে, দুই ধার তেরছা করে কাটতে হবে যেন সায়নের গোড়ার দিকটা ৩-৪ সে.মি. পর্যন্ত ক্রমশ মোটা থেকে পাতলা পাতের মত হয়।
v এখন উভয় পাশে তেরছা করে কাটা গোড়ার এই পাতমত অংশটি রুটস্টকের ফাটলের ভিতর ঢুকিয়ে মাপমত বসিয়ে দিতে হবে। তারপর পলি টেপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে।
v এরপর জোড়া লাগানো অংশসহ সম্পূর্ণ সায়নটি পলি কভার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
৫। অন্যান্য পদ্ধতিঃ
স্টোন গ্রাফটিং (Stone grafting)
আসলে স্টোন গ্রাফটিং ক্লেফট পদ্ধতি থেকে তেমন আলাদা কিছু নয়। আমের চারার একেবারে ছোট অবস্থায় (৭-৩০ দিন বয়সে) অর্থাৎ যখন আটি চারার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে ঐ সময় জোড়া কলম করাকেই স্টোন গ্রাফটিং বলে। এটি ক্লেফট পদ্ধতিতে ছোট চারার উপর করা হয়।
আমের স্টোন গ্রাফটিং এর ক্ষেত্রে যা মনে রাখতে হবে তা হলো
- যেহেতু চারাগুলো খুবই নরম থাকে, তাই পাতলা ধারালো চাকু বা ব্লেড দিয়ে জোড়া লাগানোর জন্য কাটাকাটির কাজ করতে হবে।
- স্টোন গ্রাফটিং এর চারার বৃদ্ধি প্রাথমিক পর্যায়ে কম তবে একেবারেই নিচে অর্থাৎ মাটির নিকটবর্তীতম জায়গায় করা যায় বিধায় গাছ ঝোপালো হয় ও অফসুট (জোড়া লাগার নিচের অংশে অনাকাঙ্ক্ষিত কচি ডগা) গজানোর সমস্যা কম হয়।
- তবে মনে রাখতে হবে, রুটস্টক যতই কচি বা নরম হোক না কেন, সায়ন অবশ্যই আগের বর্ণনা অনুসারে পরিপুষ্ট, সঠিক বয়সের হতে হবে।
৬। আমের জোড় কলমের সফলতার জন্য কোন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলি
v সায়না ও রুটস্টক বয়স ও আকার আকৃতির দিক থেকে পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেন তারা সহজে মিলে মিশে একাকার হতে পারে।
v রুটস্টক অবশ্যই সঠিক বয়স ও তেজের হতে হবে।
v সায়ন অবশ্যই সঠিক বয়স ও পরিপুষ্ট হতে হবে।
v গ্রাফটিং অবশ্যই সঠিক সময়ে করতে হবে।
v রুটস্টক ও সায়নের জোড়া এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে ভিতরে অবশ্যই যেন কোন ফাঁক না থাকে।