মাধবী

Saturday, September 4, 2010


সুন্দরীতমা চিরযুবতী মাধবীর রূপ-গুণ-সৌরভ কিছুরই অভাব নেই। কোনো মোক্ষম বিশেষণই তার উপযুক্ত নয়। কোনো একটি নামেই তার রূপ-গুণ সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না। কত কত তার নাম! বাসন্তী, পুণ্ড্রক, মণ্ডক, অতিমুক্ত, বিমুক্ত, কামুক ও ভ্রমরোৎসব_এসব তার মনের ভাব প্রকাশক নাম। বাসন্তী বা হলদে রঙে রঞ্জিত বলে সে বাসন্তী, আবার বসন্তকালে ফোটে সেই ভাবপ্রকাশক।
পুণ্ড্রদেশে জন্ম বলে পুণ্ড্রক। সম্পূর্ণ বিকশিত হয় বলে অতিমুক্ত। বন্ধনহীন বা নানা রোগের বন্ধন মোচন করে বলে বিমুক্ত। কামনাশীল, ইচ্ছু, দয়িত, প্রিয় বলে সে কামুক। তার ফুল ফুটলে দলে দলে ভ্রমরেরা মধু সংগ্রহে আসে বলে ভ্রমরোৎসব নাম। আবার সমার্থবাচক নাম হলো_চন্দ্রবল্লী (চন্দ্রলতা), সুগন্ধা, ভৃঙ্গপ্রিয়া (ভ্রমরপ্রিয়া), ভ্রমরোৎসব, ভদ্রলতা। আবার কামী, কার্মুক (ধনুক), অতিমুক্ত, অবিমুক্ত (অপরিত্যক্ত), সুবসন্ত, মণ্ডন, পরাশ্রয়_এসবও মাধবীর নাম। কামী নাম কেন হলো? কাকে সে কামনা করে, কার প্রতি কামনাশীল? কার জন্য কামুকী? মাধবী মদকারক সুগন্ধবিশিষ্ট বলে এই নাম? আবার মাধবী পিত্ত, কাস, ব্রণ, দাহ ও তৃষ্ণা নিবারক। মধুর, শীতবীর্য, লঘু এবং ত্রিদোষ নাশক। ত্রিদোষ অর্থ বাত, পিত্ত ও কফ নাশ করে। ওষধি গুণের জন্যও সে সবার কামী বা কাম্য।
মজার ব্যাপার হলো পুণ্ড্রক নামটি। এটি তার জন্মস্থান বা বাসস্থানের বর্ণনাদ্যোতক। পুণ্ড্র বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক সময় মাধবীর প্রাচুর্য ছিল। এখন সেখানে দুর্লভ হয়ে গেছে। মাধবীকে অবহেলার পরিণাম। মাধবীদের অবহেলা করলে সে চলে যাবেই। ওই তারারা তাকে আকাশে বরণ করে নেবে। পূর্ণিমার চাঁদ বলবে, ও দেশে তুমি থেক না। দখিনা বাতাস যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। দখিনা হাওয়ার নামই তো মলয় সমীরণ। তেমনি পারুল ফুলও এখন নেই।
বসন্ত ঋতু পর্যায়ের আর একটি গানে রবি ঠাকুর গেয়েছেন, 'হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি_'। এই গানে আরো আছে, 'বাতাসে লুকায়ে থেকে কে যে তোরে গেছে ডেকে,/পাতায় পাতায় তোরে পত্র সে যে গেছে লেখি\' বসন্তের মাধবীকে নিয়ে গাওয়া গানের বাণী লিখে কি অর্থ বোঝানো যায়! তাকে ভালোবাসতে হলে চাই গানের আসর। এ জন্যই বোধকরি বসন্তোত্সব। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব প্রবর্তন করে গেছেন। ক্ষণিকের কাম্য অতিথির জন্যও চাই উপাচার, উপকরণ ও উপহার। বসন্তের জন্যও, বাসন্তীর জন্যও, মাধবীর জন্যও। মালতি, পারুল, জুঁই, জাতি, মলি্লকা, নবমলি্লকা, শারদ মলি্লকার জন্যও চাই উৎসব-উপহার। আর মনের বনে হলেও এদের জন্য উৎসব প্রয়োজন।
ঢাকায় এখন মাধবীকে পাবেন বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ও ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে। ছবিটি ধর্মরাজিকের ঝোপালো গাছ থেকে তোলা। শিশু একাডেমী ও ধর্মরাজিকে আমি উদ্যোগ নিয়ে রুয়েছি। গত দুই বছর ধরে ধর্মরাজিকের গাছটিকে আমি ইচ্ছে করে ডালপালা ছেঁটে দেইনি। তাতে গাছটি বড় ও ঘন ঝোপালো হয়ে গেছে তার খেয়াল-খুশি মতো। তাতেই থরে থরে ফুল ফুটেছে, হয়ে উঠেছে দুর্দান্ত উসকানিমূলক যৌবনবতী সুন্দরী। ফুলের সোমত্ত গুরুভারে তার বক্ষ বিদীর্ণ হওয়ার সুগন্ধ সৌন্দর্যে ভরপুর। ডাল না ছাঁটলে তাকে বশে রাখাই দুরূহ মুশকিল। অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত, বারণ করেও ধরে রাখা মুশকিল।
তার লতা লকলক করে বেড়েই চলে। সরল লম্বা লম্বা ডালের পর্বের মাথায় পাতা ও ফুল ফোটে। ফুল আসার আগে এলোচুলে বড্ড বেমানান মনে হতে পারে, কিন্তু বসন্তে দেখবেন তাতে ফুলের যৌবনধন্য জৌলুস। কোমল রোমশ পাপড়ির স্পর্শে পার্থিব ও অপার্থিব সুখ অনুভবযোগ্য। তবে আপনি যদি মাধবীর দেখা ও স্পর্শের দুর্লভ সুযোগ পেয়ে যান। পাবেন না, কারণ মাধবীরা দুর্লভ। মাধবীরা হারিয়ে যাচ্ছে অনাদরে, অবহেলায়। এখন শৌখিন ও সৌন্দর্যপিপাসু ছাড়া মাধবীদের কেউ মনে করে না। মাধবী তাই যাকে ধরা দেয় শুধু তাকেই আকুল করা সুখ-সম্ভোগ দিতে রাজি হয়।
মাধবীকে নিয়ে রাধার বিরহ বেদনা ও পূর্ব রাগের চিত্র দিয়ে এই লেখা শেষ করলে আমাকে দোষ দেবেন না যেন,
এই তো মাধবী তলে/আমার লাগিয়া পিয়া
যোগী যেন সদাই ধেয়ায়।
পিয়া বিনে হিইয়া-কোণ/ফাটিয়া না পড়ে গো
নিলাজ পরাণ নাহি যায়।
সখি হে! বড় দুঃখ রহল মরমে
আমারে ছাড়িয়া পিয়া/মথুরা রহল গিয়া
মাধবী রহিছে আজও ভরমে।
আর মাধবী কুঞ্জে প্রিয়তম কৃষ্ণকে দেখে চন্দ্রাবলী কী বলেছিলেন শুনুন, 'ওরে সখি পদ্ম! স্বপ্নে দেখলাম মোষের গায়ের রঙের একটি নদী, তার তীরে মাধবীলতার কুঞ্জ, ফুলে ফুলে ভরা, তাই ভ্রমরের দল চারদিক মুখরিত করছে গুণ গুণ স্বরে। তারপর দেখি, ওই কুঞ্জের ভিতর বসে আছে কালোয় কালো মিশে যাওয়া এক স্বরূপ। পরণে তার হলুদ রঙের অপূর্ব বস্ত্র। অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখছি, সেও বোধহয় আমার দিকে চেয়ে আমারই মতো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।'
মাধবীর দুধ-সাদা পেলব পাপড়িতে আছে হলুদ রঙের জ্বলন্ত বসন্ত-উদ্ভাস। ওকে আপন চোখে ঘন সবুজ পাতার পটভূমিতে না দেখতে পেলে বৃথাই হবে এই বাগাড়ম্বর।
আর, অতি জরুরি বিষয়টি হলো মধুমালতীকে (কুইসকুয়ালিস ইন্ডিকা লিন, ফ্যামিলি কমব্রেটাসে) মাধবী (বৈজ্ঞানিক নাম হিপটাজে বেঙ্গলেনসিস, ফ্যামিলি মেলপিখিয়াসে) বলে অনেকে ভুল করেন। এখানে মাধবীর কথাই বলা হলো। মধুমালতী বা মধুমঞ্জরীর নয়।

মনের উঠোনে

সাম্প্রতিক সংযোজন

মোবাইল থেকে দেখুন

আমাদের দেশ এখন আপনার মুঠোফোনে, মোবাইল থেকে লগইন করুন আমাদের দেশ

দ র্শ না র্থী

দ র্শ না র্থী

free counters

কে কে অনলাইনে আছেন