বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকা প্রতি বছর বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। কয়েক শতাব্দীকাল থেকে এসব এলাকার মানুষ এই আবহাওয়ার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এসব মানুষ প্রধানত কৃষিজীবী। আর তাই জীবিকার তাগিদে তাদের পূর্বপুরুষরা মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি। মূলত বর্ষাকালে সহজলভ্য কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করে সেখানেই চলে প্রচলিত এই চাষাবাদ। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকার জন্য চলে এত সব আয়োজন।
স্খানীয়ভাবে এই ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি বায়রা, গেটো বা ধাপ চাষাবাদ নামে সুপরিচিত। গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, বরিশাল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি জেলা ও উপকূলীয় অন্যান্য এলাকায় বর্ষা মৌসুমে এই ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে লাভজনক ভাসমান চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের বিলঝিল ও বর্ষাকালে সারা দেশের জলাবদ্ধ অঞ্চলগুলোতে এটি বিকল্প চাষাবাদের লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে দেশে দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জলাভূমিতে ভাসমান চাষাবাদ করা হচ্ছে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাভূমি রয়েছে যার ৫০ হাজার হেক্টর এলাকা সফলভাবে ভাসমান চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি প্রভৃতি জলাশয় এবং বর্ষাকাল ও বন্যার সময় জলমগ্ন কৃষিজমিতে সফলভাবে ভাসমান চাষাবাদ করা যায়।
বায়রা বা বেড তৈরির পদ্ধতি : ভাসমান চাষাবাদের জন্য প্রধানত কচুরিপানা ব্যবহার করা হয়। তবে হোগলা, সোলা, নলখাগড়া, বিভিন্ন ধরনের জলজ আগাছা, ধানের খড়, নাড়া, তুষ প্রভৃতিও ব্যবহার করা যায়। জমি থেকে ধান কাটার পর গাছের যে অবশিষ্ট অংশ জমিতে থেকে যায় তাকে নাড়া বলে। এসব নাড়া সংগ্রহ করে রাখা হয় বর্ষাকালে বেড তৈরির জন্য। মে-জুন মাসে নিকটবর্তী নদী বা খাল থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে কচুরিপানা দিয়ে একটি লেয়ার তৈরি করে ৭-১০ দিন রেখে দেয়া হয়। এরপর আবার নাড়া বা কচুরিপানা দিয়ে আরেকটি লেয়ার তৈরি করা হয়। এর ওপর অনেক সময় কাদামাটি ও গোবরের একটি আস্তর দেয়া হয়। পুরো বেড তৈরি করে ফসল লাগাতে ১৮-২০ দিন সময় লাগে। এসব বেডের কোনো সুনির্দিষ্ট আকার নেই, তবে ছোট আকারের বেডের ব্যবস্খাপনা সহজ হয় এবং ফলনও তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। স্খানীয় পর্যায়ে ৮-১৫ মিটার লম্বা, ১.৫-২.০ মিটার প্রশস্ত এবং ০.৬-১.০ মিটার গভীর বেড ব্যবহার করা হয়। এসব ভাসমান বেড আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি দ্বীপ পদ্ধতি অন্যটি স্খায়ী ভাসমান পদ্ধতি। সাধারণত স্খির পানিতে দ্বীপ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যাতে বেডটি মুক্তভাবে পানিতে ভাসতে থাকে। আর প্রবহমান পানিতে স্খায়ী ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যাতে বেডটিকে খুঁটির সাহায্যে বেঁধে রাখা হয়।
ভাসমান চাষাবাদের সুবিধা : পতিত জলাবদ্ধ জমির চাষের আওতায় এনে মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো যায়। প্রচলিত চাষের জমি থেকে ভাসমান বেডগুলো অনেক বেশি উর্বর তাই ফলনও হয় বেশি। এ পদ্ধতিতে কোনো প্রকার সার বা সেচের প্রয়োজন হয় না। চাষ শেষে বেডটি জৈবসার হিসেবে রবি মৌসুমে জমিতে প্রয়োগ করা যায়। বর্ষা মৌসুমে বা জলাবদ্ধ অবস্খায় প্রয়োজনীয় সবজির চাহিদা পূরণ করা যায়। অরক্ষিত প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। বন্যার সময় ধান ও সবজির বীজতলা তৈরি করে মৌসুমি উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া বন্যার সময় এসব বেড হাঁস-মুরগির আশ্রয়স্খল হিসেবে ব্যবহার হয়। এ পদ্ধতিতে জেলেরা একই সাথে ফসল ও মৎস্যচাষ করতে পারে। এটি একটি পরিবেশবাìধব চাষাবাদ পদ্ধতি, যাতে অর্গানিক ফসল চাষ করা যায়। নিুাঞ্চলের মানুষের জন্য বিকল্প জীবিকার সংস্খান করে। ক্ষতিকর জলজ আগাছা কচুরিপানার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচনে এটি একটি লাগসই প্রযুক্তি।
চাষোপযোগী ফসল : এসব ভাসমান বেডে মূলত শাকসবজি চাষ করা হয়। প্রায় ২৩ ধরনের শাকসবজি ও মসলা চাষ করা যায়। বর্ষাকালে চাষযোগ্য ফসলগুলো হলোন্ধ ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, শসা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙে, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, কচু, বেগুন প্রভৃতি। আবার শীতকালে শিম, বরবটি, লাউ, আলু, টমেটো, মুলা, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ প্রভৃতি চাষ করা যায়। কিছু কিছু ফসল সারা বছর ধরেও চাষ করা যায়। মৌসুমি বন্যায় বর্ষাকালীন ফসল চাষের পর শীতকালীন ফসল লাগিয়ে দেয়া হয়। বর্ষা শেষে পানি শুকিয়ে গেলে বেডটি মাটিতে স্খায়ী হয় এবং বিনা চাষে রবি ফসল ফলানো যায়। অথবা বেডটি ভেঙে জমিতে মিশিয়ে দেয়া হয় ফলে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ছাড়াই রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া আগাম মৌসুমি বন্যায় ভাসমান বেডে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করা যায় এবং বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে চারা লাগিয়ে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। ভাসমান বেডে মূলত বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা হলেও প্রতিকূল পরিবেশে ধানের বীজতলা ও নার্সারি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
বেড ব্যবস্খাপনা : একটি ভাসমান বেডে এক বছর ফসল চাষ করা যায়। বেডে সরাসরি বীজ লাগানো যায়, তবে অনেক সময় আরেকটি ভাসমান পিটে (যা স্খানীয়ভাবে টেমা নামে পরিচিত) চারা তৈরি করে পরে পিটটি বেডে স্খানান্তর করা হয়। ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে কৃষককে কোনো প্রকার সার বা সেচ প্রদান করতে হয় না। তবে অনেক সময় পোকামাকড় ও ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। এ ছাড়া বেডে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে লাগানো বীজ নষ্ট হয়ে যায়। এসব বেডে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকায় বেশ ঘন করে ফসল লাগানো হয়। গভীর পানিতে বেড তৈরি করলে বেডের আন্ত:পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহের জন্য নৌকার প্রয়োজন হয়। ভাসমান বেডে শাকসবজি চাষ বেশ লাভজনক। বর্ষাকালে এমনিতেই শাকসবজির দাম বেশি থাকে। আবার ভাসমান বেডে তৈরি হওয়া জৈব সারের কারণে জমিতে প্রচলিত চাষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। এ ছাড়া এসব বেডে রবি মৌসুমের জন্য আগাম বীজতলা তৈরি করা যায় ও আগাম ফসল তুলে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়।
শেষ কথা : বাংলাদেশে ভাসমান চাষাবাদের ইতিহাস ৩০০ থেকে ৪০০ বছরের পুরনো। আমাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষরা জীবিকার প্রয়োজনে তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে চাষের এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। অথচ এজাতীয় হাইড্রোপনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ভবিষ্যতের চাষাবাদ পদ্ধতি হিসেবে এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। এটা আমাদের সমৃদ্ধ জাতিসত্তার প্রমাণ বহন করে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবার অন্য দিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন সাময়িক ও দীর্ঘস্খায়ী বন্যা, দীর্ঘমেয়াদি বর্ষাকাল, উপকূলীয় এলাকার জলাবদ্ধতা প্রভৃতি প্রচলিত কৃষিব্যবস্খার জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এ অবস্খায় প্রতিকূল পরিবেশের সাথে চাষাবাদ পদ্ধতিকে অভিজোযিত করা একান্ত প্রয়োজন। ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি ও উন্মুক্ত জলাশয় মৎস্য চাষের পাশাপাশি ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। তাই ফসল চাষের আওতা বৃদ্ধি করা এবং বছরজুড়ে এমনকি প্রতিকূল পরিবেশেও ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি নি:সন্দেহে একটি চমৎকার লাগসই বিকল্প।
লেখক: আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ
স্খানীয়ভাবে এই ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি বায়রা, গেটো বা ধাপ চাষাবাদ নামে সুপরিচিত। গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, বরিশাল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি জেলা ও উপকূলীয় অন্যান্য এলাকায় বর্ষা মৌসুমে এই ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে লাভজনক ভাসমান চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের বিলঝিল ও বর্ষাকালে সারা দেশের জলাবদ্ধ অঞ্চলগুলোতে এটি বিকল্প চাষাবাদের লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে দেশে দুই হাজার ৫০০ হেক্টর জলাভূমিতে ভাসমান চাষাবাদ করা হচ্ছে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাভূমি রয়েছে যার ৫০ হাজার হেক্টর এলাকা সফলভাবে ভাসমান চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি প্রভৃতি জলাশয় এবং বর্ষাকাল ও বন্যার সময় জলমগ্ন কৃষিজমিতে সফলভাবে ভাসমান চাষাবাদ করা যায়।
বায়রা বা বেড তৈরির পদ্ধতি : ভাসমান চাষাবাদের জন্য প্রধানত কচুরিপানা ব্যবহার করা হয়। তবে হোগলা, সোলা, নলখাগড়া, বিভিন্ন ধরনের জলজ আগাছা, ধানের খড়, নাড়া, তুষ প্রভৃতিও ব্যবহার করা যায়। জমি থেকে ধান কাটার পর গাছের যে অবশিষ্ট অংশ জমিতে থেকে যায় তাকে নাড়া বলে। এসব নাড়া সংগ্রহ করে রাখা হয় বর্ষাকালে বেড তৈরির জন্য। মে-জুন মাসে নিকটবর্তী নদী বা খাল থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে কচুরিপানা দিয়ে একটি লেয়ার তৈরি করে ৭-১০ দিন রেখে দেয়া হয়। এরপর আবার নাড়া বা কচুরিপানা দিয়ে আরেকটি লেয়ার তৈরি করা হয়। এর ওপর অনেক সময় কাদামাটি ও গোবরের একটি আস্তর দেয়া হয়। পুরো বেড তৈরি করে ফসল লাগাতে ১৮-২০ দিন সময় লাগে। এসব বেডের কোনো সুনির্দিষ্ট আকার নেই, তবে ছোট আকারের বেডের ব্যবস্খাপনা সহজ হয় এবং ফলনও তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। স্খানীয় পর্যায়ে ৮-১৫ মিটার লম্বা, ১.৫-২.০ মিটার প্রশস্ত এবং ০.৬-১.০ মিটার গভীর বেড ব্যবহার করা হয়। এসব ভাসমান বেড আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি দ্বীপ পদ্ধতি অন্যটি স্খায়ী ভাসমান পদ্ধতি। সাধারণত স্খির পানিতে দ্বীপ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যাতে বেডটি মুক্তভাবে পানিতে ভাসতে থাকে। আর প্রবহমান পানিতে স্খায়ী ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যাতে বেডটিকে খুঁটির সাহায্যে বেঁধে রাখা হয়।
ভাসমান চাষাবাদের সুবিধা : পতিত জলাবদ্ধ জমির চাষের আওতায় এনে মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো যায়। প্রচলিত চাষের জমি থেকে ভাসমান বেডগুলো অনেক বেশি উর্বর তাই ফলনও হয় বেশি। এ পদ্ধতিতে কোনো প্রকার সার বা সেচের প্রয়োজন হয় না। চাষ শেষে বেডটি জৈবসার হিসেবে রবি মৌসুমে জমিতে প্রয়োগ করা যায়। বর্ষা মৌসুমে বা জলাবদ্ধ অবস্খায় প্রয়োজনীয় সবজির চাহিদা পূরণ করা যায়। অরক্ষিত প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। বন্যার সময় ধান ও সবজির বীজতলা তৈরি করে মৌসুমি উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়া বন্যার সময় এসব বেড হাঁস-মুরগির আশ্রয়স্খল হিসেবে ব্যবহার হয়। এ পদ্ধতিতে জেলেরা একই সাথে ফসল ও মৎস্যচাষ করতে পারে। এটি একটি পরিবেশবাìধব চাষাবাদ পদ্ধতি, যাতে অর্গানিক ফসল চাষ করা যায়। নিুাঞ্চলের মানুষের জন্য বিকল্প জীবিকার সংস্খান করে। ক্ষতিকর জলজ আগাছা কচুরিপানার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচনে এটি একটি লাগসই প্রযুক্তি।
চাষোপযোগী ফসল : এসব ভাসমান বেডে মূলত শাকসবজি চাষ করা হয়। প্রায় ২৩ ধরনের শাকসবজি ও মসলা চাষ করা যায়। বর্ষাকালে চাষযোগ্য ফসলগুলো হলোন্ধ ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, শসা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙে, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, কচু, বেগুন প্রভৃতি। আবার শীতকালে শিম, বরবটি, লাউ, আলু, টমেটো, মুলা, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ প্রভৃতি চাষ করা যায়। কিছু কিছু ফসল সারা বছর ধরেও চাষ করা যায়। মৌসুমি বন্যায় বর্ষাকালীন ফসল চাষের পর শীতকালীন ফসল লাগিয়ে দেয়া হয়। বর্ষা শেষে পানি শুকিয়ে গেলে বেডটি মাটিতে স্খায়ী হয় এবং বিনা চাষে রবি ফসল ফলানো যায়। অথবা বেডটি ভেঙে জমিতে মিশিয়ে দেয়া হয় ফলে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ছাড়াই রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া আগাম মৌসুমি বন্যায় ভাসমান বেডে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করা যায় এবং বন্যার পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে চারা লাগিয়ে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। ভাসমান বেডে মূলত বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করা হলেও প্রতিকূল পরিবেশে ধানের বীজতলা ও নার্সারি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
বেড ব্যবস্খাপনা : একটি ভাসমান বেডে এক বছর ফসল চাষ করা যায়। বেডে সরাসরি বীজ লাগানো যায়, তবে অনেক সময় আরেকটি ভাসমান পিটে (যা স্খানীয়ভাবে টেমা নামে পরিচিত) চারা তৈরি করে পরে পিটটি বেডে স্খানান্তর করা হয়। ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে কৃষককে কোনো প্রকার সার বা সেচ প্রদান করতে হয় না। তবে অনেক সময় পোকামাকড় ও ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। এ ছাড়া বেডে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে লাগানো বীজ নষ্ট হয়ে যায়। এসব বেডে গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকায় বেশ ঘন করে ফসল লাগানো হয়। গভীর পানিতে বেড তৈরি করলে বেডের আন্ত:পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহের জন্য নৌকার প্রয়োজন হয়। ভাসমান বেডে শাকসবজি চাষ বেশ লাভজনক। বর্ষাকালে এমনিতেই শাকসবজির দাম বেশি থাকে। আবার ভাসমান বেডে তৈরি হওয়া জৈব সারের কারণে জমিতে প্রচলিত চাষের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়। এ ছাড়া এসব বেডে রবি মৌসুমের জন্য আগাম বীজতলা তৈরি করা যায় ও আগাম ফসল তুলে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়।
শেষ কথা : বাংলাদেশে ভাসমান চাষাবাদের ইতিহাস ৩০০ থেকে ৪০০ বছরের পুরনো। আমাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষরা জীবিকার প্রয়োজনে তাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে চাষের এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। অথচ এজাতীয় হাইড্রোপনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ভবিষ্যতের চাষাবাদ পদ্ধতি হিসেবে এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। এটা আমাদের সমৃদ্ধ জাতিসত্তার প্রমাণ বহন করে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবার অন্য দিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন সাময়িক ও দীর্ঘস্খায়ী বন্যা, দীর্ঘমেয়াদি বর্ষাকাল, উপকূলীয় এলাকার জলাবদ্ধতা প্রভৃতি প্রচলিত কৃষিব্যবস্খার জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এ অবস্খায় প্রতিকূল পরিবেশের সাথে চাষাবাদ পদ্ধতিকে অভিজোযিত করা একান্ত প্রয়োজন। ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি ও উন্মুক্ত জলাশয় মৎস্য চাষের পাশাপাশি ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। তাই ফসল চাষের আওতা বৃদ্ধি করা এবং বছরজুড়ে এমনকি প্রতিকূল পরিবেশেও ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি নি:সন্দেহে একটি চমৎকার লাগসই বিকল্প।
লেখক: আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ