ক্ষেত থেকে আলু তোলার পরপরই সব আলু বিক্রি হয় না এবং তা খাওয়া যায় না। এক মৌসুমে উৎপাদিত আলু দিয়েই আমাদের সারা বছর চলতে হয়। তাই আলু তোলার পর ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে তা নষ্ট হয়। তবে ঘরে বা হিমাগারে যেখানেই আলু সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সংরক্ষণযোগ্য আলুর মান ভালো না হলে সেসব আলু বেশি দিন ভালো থাকে না এবং পরের বছর তা বীজ আলু হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আলুর মান ভালো করার জন্য আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মান ভালো রাখতে প্রয়োজন আলু তোলার সময় এবং তোলার পর তার ব্যবস্থাপনা। এটুকু সঠিকভাবে করতে পারলেই আলুর মান বাড়ে, বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় এবং পরে দামও ভালো পাওয়া যায়। এখন আলু উঠতে শুরু করেছে। তাই তোলার সময় আলুচাষি ভাইরা নিুলিখিত কাজগুলো করে আলুর মান বাড়াতে পারেন।
আলু তোলার আগে গাছ পাতা ছাঁটাইঃ যেসব ক্ষেত থেকে বীজ হিসেবে আলু রাখা হবে সেসব ক্ষেত থেকে আলু তোলার আগেই মাটির ওপর থেকে গাছ কেটে ফেলতে হবে। সাধারণত আলু রোপণের ৮০ দিন পর এ কাজ করা হয়। তবে জাতভেদে এ সময়ের হেরফের হতে পারে। গোড়া থেকে গাছ কেটে সেসব গাছ কম্পোস্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। তোলার আগে গাছ কাটলে আলুর খোসা দ্রুত শক্ত হয়ে ওঠে। আলুও শক্ত হয়। সুতরাং সেগুলো একটু তাড়াতাড়ি তোলা যায়। সাধারণত গাছ কাটার দুই সপ্তাহ পর আলু তোলা হয়। তা ছাড়া এভাবে গাছ কাটার ফলে রোগাক্রান্ত গাছের কাণ্ড থেকে বিভিন্ন রোগের জীবাণু আলুতে প্রবাহিত হতে পারে না। বিশেষ গাছ না কেটে রেখে দিলে যখন কাণ্ড ঢলে শুকিয়ে যেতে শুরু করে তখন গাছে থাকা ভাইরাস জীবাণুগুলো আলুতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এসব আলু বীজ হিসেবে রেখে পরে রোপণ করলে সেসব গাছ ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
একইভাবে মড়ক, কাণ্ডপচা এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগও প্রতিহত করা যায়। আলু তোলার সময়ঃ জাতভেদে সাধারণত রোপণের ১০০ থেকে ১১০ দিন পর আলু তোলা হয়। সঠিক সময়ের আগে বা পরে কখনো আলু তোলা উচিত নয়। এতে বীজ আলুর মান খারাপ হয়ে যায়। পরিষ্কার দিনে বা রৌদ্রযুক্ত আবহাওয়ায় আলু তুলতে হবে। কেননা রোদ দ্রুত আলু শুকাতে ও শক্ত হতে সাহায্য করে। তোলার পর আলু থেকে আলগা মাটি অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে। বৃষ্টির মধ্যে আলু তুললে সেসব আলু দ্রুত পচে যেতে পারে। বৃষ্টি বা মেঘলা থাকলে কয়েক দিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে আলু তোলার উপযুক্ত সময়ের ১০ দিন পর যাওয়া ঠিক নয়। এতে আলুর মান খারাপ হয়, ওই উড়চুঙ্গা ফুটো করে, দাদ বা স্ক্যাব রোগ হয়। আলু তোলার পদ্ধতিঃ আলু তোলার সময় সতর্ক না হলে আলুর মান খারাপ হয়। দু’ভাবে আলু তোলা যায় হাত দিয়ে এবং নিড়ানি বা কোদাল ব্যবহার করে। হাত দিয়ে আলু তোলা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ হলেও বীজ আলুর জন্য এ পদ্ধতি উত্তম। এতে আলুর কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু নিড়ানি বা কোদাল দিয়ে আলু তুললে অনেক আলু কেটে যায় বা ক্ষত হয়। পরে সেসব ক্ষত আলুর বিভিন্ন রোগ বয়ে আনে, ক্ষত আলু সংরক্ষণ করা যায় না। কোনো কোনো জায়গায় আলুর সারির মধ্য দিয়ে হাতে লাঙল টেনে মাটি আলগা করে পরে হাত দিয়ে আলু তোলা হয়। তবে এ সময় সতর্ক থাকতে হয় যেন কোনোভাবেই আলু কাটা না পড়ে। আলু তুলে ক্ষেতের মধ্যেই মাঝেমধ্যে স্তূপ করে রোদে ফেলে রেখে দিলে শুকিয়ে যায়। তখন আলগা মাটি পরিষ্কার করতে সুবিধা হয় এবং আলুও শক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তোলার পর পরিচর্যাঃ তোলার পর ক্ষেতে বা গুদাম ঘরের আশপাশে খোলা জায়গায় আলু ছড়িয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর পরিষ্কার করে বাছাই করা দরকার। ওজনভিত্তিতে বা অভিজ্ঞতার আলোকে আলুকে গ্রেডিং করতে হয়।
তবে গ্রেডিং করার আগে অবশ্যই কাটা, ক্ষত ও রোগ পোকায় আক্রান্ত আলু বেছে আলাদা করতে হবে। ওজনভিত্তিতে আলুকে চারটি গ্রেডে ভাগ করা যেতে পারে প্রতি কন্দের ওজন ৮০ গ্রামের ঊর্ধ্বে, ৬০-৮০ গ্রাম, ৩০-৬০ গ্রাম ও ৩০ গ্রামের নিচে। প্রতিটি আলুর ওজন ৬০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হলে সেগুলো বীজের জন্য না রেখে বা হিমাগারে না রেখে বিক্রি করে দেয়া ভালো। বীজের জন্য ৩০-৬০ গ্রাম আকারের আলু ভালো। গ্রেডিংয়ের পর যথারীতি বস্তায় ভরে স্থানান্তর করতে হয় বা গুদামে-হিমাগারে রাখতে হয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত