ইউরিয়ার দ্রবণ স্প্রে করলে কাজ হয় না এবং এটা বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ইউরিয়া পানিতে গুলিয়ে দ্রবণ তৈরি করার পর পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়। ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করার সময় অ্যামোনিয়া হাইড্রো-অক্সাইড ভেঞ্চ অ্যামোনিয়া গ্যাস ও পানি হয়। বিক্রিয়া রোদে ইউরিয়ার পানি স্প্রে করলে আরও দ্রুত ভেঙে অ্যামোনিয়া গ্যাস হবে। এই অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঘনত্ব ৮ দশমিক ৫ এবং বাতাসের ঘনত্ব ১৪ দশমিক ৪। অতএব বাতাসের চেয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস হালকা বলে বাতাসে উড়ে যাবে। গাছের কাজের লাগবে না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আইএফডিসির গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা গেছে, ইউরিয়া ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ভাগ গাছ গ্রহণ করতে পারে। বাকি ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ অপচয় হয়। ইউরিয়া বাতাসের সংস্পর্শে এলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বাষ্পীভূত পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস, নাইট্রিফিকেশন, ডিনাইট্রিফিকেশন এবং নাইট্রোজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস হিসেবে উড়ে যায়। বাকি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ নাইট্রেট হিসেবে চুইয়ে ভূগর্ভের পানির স্তরে মিশে যায়। বাষ্পীভূত অপচয় রোধের জন্য গুটি ইউরিয়া মাটির গভীরে প্রয়োগ করা হয়। ইউরিয়ার পানি বাষ্পীভূত হয় বলে পাতা বা কাণ্ডের ভেতরের জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যুতে পৌঁছাতেই পারবে না। সাধারণভাবে দেখা যায়, ইউরিয়া উন্মুক্ত অবস্থায় রাখলে গলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়। দুই· মাটিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে শিকড়ের নরম মূলত্বক দিয়ে রাসায়নিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় অ্যামোনিয়াম আয়ন কর্টেক্সে প্রবেশ করে। ওয়াকারের তত্ত্ব অনুসারে শিকড়ের শ্বসন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড তৈরি করে। কার্বনিক এসিড ভেঙে হাইড্রোজেন আয়ন ও বাই-কার্বনেট আয়ন জোড়া সৃষ্টি হয়। এই আয়ন জোড়া কর্দমপৃষ্ঠে প্রতিস্থাপিত হয়ে হাইড্রোজেন আয়ন ও অ্যামোনিয়াম আয়ন দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে নতুন আয়ন জোড়া সৃষ্টি হয়। এই আয়ন জোড়া মূলের পৃষ্ঠের হাইড্রোজেন আয়নের সঙ্গে বিনিময় করে অ্যামোনিয়াম আয়ন মূলের মধ্যে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার জন্য মাটির পরিবেশ প্রয়োজন। পাতা বা কাণ্ডে মাটির এই পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। অপরদিকে পাতার ওপরে শক্ত কিউটিকলের স্তর থাকায় অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না। পত্ররন্ধ্র দিয়ে অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ পত্ররন্ধ্রের কাজ হচ্ছে গাছের অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া, বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন ত্যাগ করা। উল্লেখ্য, ইউরিয়া থেকে অ্যামোনিয়াম আয়ন গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে শিকড়। অধিকাংশ গাছের পত্ররন্ধ্র পাতার নি্নপৃষ্ঠ থাকে বলে অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না। তিন· গাছের অধিকাংশ পাতা তৈলাক্ত বলে পাতায় পানি অথবা ইউরিয়া স্প্রে করা পানি লেগে থাকে না। স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামোনিয়া উড়ে যায়, শুধু পানি নিচে পড়ে। দেশের ৮০ শতাংশ ইউরিয়া ধানক্ষেতে প্রয়োগ করা হয়। ধানের পাতায় ইউরিয়ার পানি লেগে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। চার· ইউরিয়া বিষাক্ত পদার্থ বলে প্রয়োগের সময় গাছের কাণ্ড, পাতা ও শিকড়ে লাগলে পুড়ে যায়। এ জন্য কাণ্ড ও পাতা ভেজা অবস্থায় ইউরিয়া প্রয়োগ করা নিষেধ। শিকড় থেকে একটু দূরে প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়ার ঘন দ্রবণ স্প্রে করলে পাতা ও কাণ্ড পুড়ে যেতে পারে। ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করলে গাছের ভেতর প্রবেশ করবে না। তাহলে ঘাটাইলে ফলন ভালো হলো কেন? এর কারণ হলো, ওই এলাকা পাহাড়ি হওয়ায় মাটি উর্বর। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বরই, আম, জাম, কাঁটাল প্রভৃতি ফলগাছে কেউ কখনো সার দেয় না, কিন্তু ফল ধরে প্রচুর। আর ঘাটাইলের ওই গ্রামের মাটি উর্বর হওয়ায় ফলন বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রের কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
ফরহাদ আহম্মেদ
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত