পুকুরে শোল ও টাকি মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতিঃ আমি আগেই উল্লেখ করেছি- হ্যাচারিতে শোল মাছের পোনা চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে উৎপাদন খুবই জটিল। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা খুবই সহজ। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতির বর্ণনা করছি-
ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাসে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর প্রথমে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর ২০/২৫ দিন এভাবে শুকিয়ে রাখতে হবে। এতে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাস জন্মে। ঘাস জন্মালে পুকুরে পানি দিয়ে ভরতে হবে। এরপর পানির নীচে এসব ঘাস ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে এবং একসময় এই ঘাসগুলো পানির উপর ভেসে উঠবে। এ সময় কচুরীপানাও দেয়া যেতে পারে পুকুরে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কচুরীপানায় যেন পুকুর ভরে না যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পুকুরে ঘাস হয়ে গেলে কচুরীপানা দেয়ার প্রয়োজন নেই। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড় দিত হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে শোল মাছ লাফিয়ে চলে যাবে। এরপরে পুকুরে শোল টাকি মাছ মজুদ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৪টি শোল ও ১০টি টাকি মাছ মজুদ করা যেতে পারে। মজুদের পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের ধানীপোনা দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট ছোট ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি দেয়া যেতে পারে। ছোট ব্যাঙ অনেক সময় লাফিয়ে চলে যেতে পারে। সে জন্য ব্যাঙগুলোকে আধমরা করে দিতে হবে। ব্যাঙাচি দিলে আধমরা করার কোন প্রয়োজন নেই। ব্রুড শোল ও টাকি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যাঙাচির তুলনা হয় না। এ জন্য ব্যাঙাচির চাষ করা যেতে পারে। ব্যাঙাচি উৎপাদন করাও খুব কঠিন কিছু নয়।
বৈশাখ মাসের প্রথম থেকে শোল ও টাকি মাছ বাচ্চা দিতে (বাইশ) শুরু করে। বাচ্চাগুলো এক ঝাঁকে থাকে। সপ্তাহখানেক বয়সের হলেই ঠেলা জালি দিয়ে বাইশ (পোনার ঝাঁক) ধরে সিস্টার্ণ বা হাউজে নিয়ে যেতে হবে। খাদ্য হিসেবে প্রথম ১/২ দিন কিছুই খেতে চায় না। তারপরে খাবার হিসেবে চিংড়ি শুটকির গুঁড়া ভালভাবে পিষিয়ে দিতে হয়। এভাবে ২/৩ দিনেই খাবারে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো প্রায় ২/৩ ইঞ্চি সাইজ হয়। এরপর পোনাগুলোকে চাষের জন্য অবমুক্ত করতে হবে।
শোল ও টাকি মাছের চাষ পদ্ধতিঃ আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে শোল বা টাকি মাছের চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- শোল মাছ সাধারনত খৈল বা কুড়া দিয়ে বানানো খাবার খায় না। তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খুব খায়। আমাদের দেশে বা-বতার নিরিখে শোল মাছের একক চাষের সম্ভবনা খুবই কম। কারণ এত কাঁচা মাছ বা শুটকির জোগান দেয়া প্রায় অসম্ভব। তবে যেকোন মাছের সাথে মিশ্রভাবে প্রতি ২ শতাংশে ১টি করে শোল মাছ দেয়া যেতে পারে। শোল মাছের চেয়ে পুকুরে টাকি মাছের চাষ করার একটা বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, শুটকি মাছের গুঁড়া মিশ্রিত খৈল ও কুড়া দিয়ে বানানো খাবার টাকি মাছ ভাল খায় এবং বেশ মোটাতাজাও হয় যা শোল মাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
শোল মাছ আমাদের দেশে এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতীর মাছ হয়ে যাচ্ছে। এ মাছটিকে উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে সরকারি উদ্যোগে মুক্ত জলাশয়ে ছাড়লে একদিকে যেমন এ মাছটির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়বে অন্যদিকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শোল মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে অনায়াসে। আবার টাকি মাছটিকেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে যেকোন মাছের সাথে শতাংশ প্রতি ১০টি মাছ অনায়াসে চাষ করে এর ব্যাপক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
এ· কে· এম· নূরুল হক, শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত