আদিযুগ থেকে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ ও নিরাপত্তার জন্য দলবদ্ধভাবে বসবাস করছে। এই দলবদ্ধভাবে বসবাস করার ফলে নিজেদের খাদ্য জোগাড় ও পশু শিকার করে আসছে। এমনকি যেকোন আক্রমণ প্রতিহত করতেও সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ এখনও কৃষি নির্ভর। অথচ কৃষক তার নিজেরও পরিবারের আহার জোগাড় করতে পাচ্ছে না কোন নিশ্চয়তা। আবার পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থায়ও নেই কোন নিরাপত্তা। দেশের কৃষিখাতটি হল এমন, কারও জন আছেতো জমি নেই, আবার জমি আছেতো জন নেই। বীজ আছেতো সার নেই, সার আছেতো বীজ নেই। পণ্য আছেতো মূল্য নেই, আবার মূল্য আছেতো পণ্য নেই। দেশের কৃষককূল প্রথম থেকেই সমস্যাসংকূল অবস্থা নিয়ে বংশ পরস্পরায় বেঁচে আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্যেরমত অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হতে কৃষক সমাজ রয়েছে সবসময় বঞ্চিত। যে দেশের অর্থনীতি কৃষিকে নিয়ে, জীবন ব্যবস্থা কৃষিকে নিয়ে, সে দেশে বর্তমান তথ্য-যোগাযোগের সময়েও কৃষক জানেনা তার সমস্যার সমাধান কোথায়। তার পণ্যের ন্যায্যমূল্যই বা কি। কৃষক থেকে ভোক্তা, পণ্যের উৎপাদক থেকে ভোগকারি হিসেবে শ্রম ও বিনিময়ে যা দেয় এবং নেয়, তার থেকেও বেশি পায় বিনাশ্রমে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা।
২০০৯ সালে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের বি-র প্রভাবের যুগেও আমাদের কৃষক রয়েছে সবকিছু থেকে অবহেলিত ও বঞ্চিত। কৃষকের জন্য ভাবনার অবকাশ খুব কম। তাদের কোন সংগঠন নেই, সমস্যার কোন প্রতিবাদ নেই। তথ্য আছে তা আদান-প্রদানের বি-র ব্যবস্থা নেই। কৃষকের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথ না কাঁপলেও, মনোনয়ন বঞ্চিতরা প্রতিবাদের নামে দেশের সম্পদ ধ্বংস করে রাজপথ কাঁপায়। নতুন বছরের সূচনাতে আসুন ভাবি- কৃষককে বলতে দেয়ার জন্য, জানতে দেয়ার জন্য। তাদেরকে একত্রিত করে কৃষিক্ষেত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি। যাতে তারা বীজের জাত নির্ণয়ে, মাটির উপাদানগত তথ্য জানতে, জল ও সার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পেতে, পোকা-মাকড়ের হাত থেকে ফসল বাঁচানোর উপায় খুঁজতে, পণ্যমূল্য নির্ধারণগত তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। শুধুমাত্র সংগঠনের অভাবে তারা পারে না অভিজ্ঞতা বিনিময় করে তাদের সমস্যার সমাধান করতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে জানা যায়, ২০০৭ সালের হিসেবে দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৬৮·২৭ লক্ষ হেক্টর। আর দেশে বর্তমান আবাদি জমির পরিমাণ সে তুলনায় বেশ কম। যে জন্য কোন না কোন ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবাদি জমিতে ফসল উৎপাদনে রয়েছে বিচিত্রতা। আবহাওয়া, সার-সেচ, তাপমাত্রা, বীজ ভিন্নতার জন্য অঞ্চলভেদে উৎপাদনে রয়েছে পার্থক্য। একই উপজেলার একপাশে একটি পণ্যের মান অনুযায়ী যে মূল্য, ঠিক কাছাকাছি এলাকায় ওই মানের পণ্যের মূল্যতে রয়েছে পার্থক্য। তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে কৃষক যেমন ফিরে পেতে পারে তার পণ্যের সঠিক মূল্য, আবার ভোক্তা পেতে পারে উপযুক্ত মূল্যে সঠিক সেবার নিশ্চয়তা। কৃষির নিয়ামক শক্তি হল কৃষক। এই কৃষকের পাশে দাঁড়ালে আমাদের জাতীয় উৎপাদনকে গতিশীল করতে পারবে তারা। সে জন্য দরকার কৃষকের ক্লাব বা কৃষকের ছাতা। যেখানে মত প্রকাশের মাধ্যমে পথের সন্ধান করে তারা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। একই ছাতার তলে বসে কৃষকেরা তাদের সব সেবা পাবে। আবার এই আমব্রেলায় বসে কৃষক জমিতে বীজ বুনার আগে হিসেব করতে পারবে- এবারে কোন ফসল উৎপাদন করলে এবং কতটুকু জমি ওই ফসলের জন্য ব্যবহার করলে তার ফসলের অপচয় হবে না। এভাবে আমাদের জমির সুষম উৎপাদনে পবিমাণগত ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। পাশাপাশি ফসলের সুষমবণ্টনও সহজ হবে। এভাবে মুনাফাখোর মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আঞ্চলিক কৃষি উৎপাদনে কৃষকের ছাতা কাজ করতে পারে। কেননা তথ্যের আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য এলাকাভিত্তিক কৃষি ফসলের উৎপাদন করলে ফসলের অপচয় যেমন রোধ করা যায়, তেমন অপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোন ব্যবহার হয় না।
কৃষক আমব্রেলা গঠন করতে হবে এলাকা ভিত্তিক জমি বা কৃষকের ঘনত্ব বিবেচনা করে। আবার ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড ভিত্তিকও এ সংগঠন দাঁড় করানো যায়। এই প্রতিটি ছাতার তলে পরামর্শক হিসেবে থাকবে সরকারের সেবাদানকারি প্রতিটি সংস্থার প্রতিনিধিরা। মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কৃষক যেমন তার অভিজ্ঞতা প্রদান করবেন, আবার অন্যের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা গ্রহণও করবেন। এই ক্লাবে এলাকার কৃষকের সম- তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। কৃষকের ভাল কাজের জন্য প্রশংসার পাশাপাশি পুরস্কারের মাধ্যমে কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। আবার একজন অজ্ঞ চাষিকে চাষাবাদে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এই সংগঠন কাজ করবে। কৃষি শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য জনগণের সাথে এক হয়ে কাজ করতে হবে। যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই পল্লীর উন্নয়নের জন্য এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষা; বিশেষ করে কৃষি ও কৃষিযন্ত্রের শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের এখন ভাবার বিষয়; সময় উপযোগী কৃষিশিক্ষা ও তার উপস্থাপনায় কোন বিঘ্ন ঘটলে সে খেসারত আমাদেরই দিতে হবে। ক্রমসংকুচিত আবাদি জমিতে সময় উপযোগী উৎপাদনের পদক্ষেপ নিতে না পাড়লে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় দারুণ প্রভাব পড়বে।
আমাদের সরকার অনেক দেরীতে হলেও কৃষকের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১ অগ্রহায়ণ “জাতীয় কৃষি দিবস” হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে এবারই প্রথমবারের মত পালিত হয়েছে জাতীয় কৃষি দিবস। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ কৃষককে তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
১৫ কোটি মানুষের অন্ন যোগানদাতা এই কৃষক। কৃষককে তার কাজের যতটা মূল্যায়ণ ও স্বীকৃতি দেয়া যাবে, তাদেরকে যতটা নিরাপত্তায় রাখা যাবে, ততই আমাদের দেশের অর্থনীতি হবে সাবলম্বী এবং গতিশীল। আমরা বলতে পারি কৃষকের আমব্রেলা তৈরির জন্য একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে ২০০৯ সালের শুরুতেই বা-বায়নের শুভ সূচনাটা করা যায়। অর্থাৎ ছাতার তলের শীতল ছায়া বা কৃষকের ছাতাই হোক তাদের সকল সুখ ও দুঃখের ভাব বিনিময়ের পবিত্র স্থান।
তথ্যসূত্র: শাইখ সিরাজ রচিত ‘মাটি ও মানুষের চাষবাস’ গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত