Saturday, July 9, 2011

আম রাজ্যে উৎসব


চাঁপাইনবাবগঞ্জের 'আম অর্থনীতি' এখন চাঙ্গা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বেচাকেনার পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের আম-কাজ আর পর্যটকদের পদচারণায় এখন রীতিমতো মহোৎসব চলছে সেখানে। এ বছর আমের ফলন ভালো হয়েছে।
জেলার প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর আম বাগান আর চারটি প্রধান আমের বাজারে এ বছর বেচাকেনা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আম নিয়ে ব্যস্ততা চলবে আরো দুই মাস। মাটি ও আবহাওয়ার কারণে সুস্বাদু আম উৎপাদনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি সেই প্রাচীনকাল থেকে। রুক্ষ-লাল মাটির বরেন্দ্র অঞ্চলেও ঘটে চলেছে আম বিপ্লব। নতুন করে যোগ হয়েছে চরাঞ্চল। সব মিলিয়ে জেলায় এখন আমগাছের সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। এ বছর আম উৎপন্ন হবে প্রায় সোয়া দুই লাখ মেট্রিক টন।

আমের বাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জে চারটি প্রধান বাজারসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় অর্ধশত বাজার রয়েছে। এর মধ্যে দেশের প্রধান আমের বাজার শিবগঞ্জের কানসাট। এটি আমের আদি বাজার। জেলা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরের এ বাজারে এখন আম আর আম। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারজুড়ে বাজার। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাবেচা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোট আমের ৬০ শতাংশ উৎপাদিত হয় শিবগঞ্জে এবং কানসাট বাজারটি উপজেলার মাঝামাঝি স্থানে থাকায় এখানে প্রতিদিন প্রচুর আম আসে এবং বিক্রি হয়। জেলার ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও সদর উপজেলায়
উৎপাদিত আমের একটা বড় অংশ বিক্রি হয় কানসাট বাজারে।
কানসাট আম আড়তদার সমিতি সূত্র জানিয়েছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় ছয় কোটি টাকার আম কেনাবেচা হয়। আম মাপার হিসাবটাও আলাদা। ৪৫ থেকে ৪৮ কেজিতে এক মণ ধরা হয়। এখন প্রতিদিন প্রায় দেড় শ ট্রাক বোঝাই আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আমের বড় বাজারটি বসে পুরান বাজারে। মহানন্দা নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন এ আমের বাজার এখন রমরমা। সদর, শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় বাজারে আসছে আম, যাচ্ছে টাকা।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে রহনপুর। এখানে রেলস্টেশনের সামনে আমের বাজার। গোমস্তাপুর, ভোলাহাটসহ প্রভৃতি এলাকা থেকে আম আসে। এখানে গড়ে ওঠা প্রায় ১২৫টি আড়ত থেকে দেশের পাইকারি ক্রেতারা আম কিনে নিয়ে যায়। সরগরম রহনপুর, তবে ফজলি আম বাজারে এলে এই বাজার আরো তেজি হয়ে উঠবে। সীমান্ত উপজেলা ভোলাহাট। এখানকার আম প্রতিদিন ফাউন্ডেশন বাজারে বেচাকেনা হয়।

ব্যস্ত সবাই
তিন মাসের আম মৌসুম। প্রায় ছয় লাখ মানুষের ব্যস্ত সময় কাটছে। মুকুল পরিচর্যা থেকে শুরু করে আম কেনাবেচা ও মধ্যস্থতার কাজ_এসব নিয়েই কেটে যায় দিন। এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ তাকিয়ে থাকে এ সময়ের জন্য। আম মৌসুম মানেই তাদের সুখের দিন।
আমকর্মী কাশেম জানান, 'বাগানে কাজ করার সময় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া পাই আর ম্যালাই (প্রচুর) আম খাইয়্যা শরীরখানটাও তাজা হইয়া য়ায়। বাগান শ্যাষ কোর‌্যা যখন বাড়ি যায় তখন বাড়িআলীট্যা (স্ত্রী) মুখের দিকে তাকিয়্যা থাকে। তাজা মুখখানটা দেখ্যা খুশিই হয়।'

বালাই নিয়ে বিপাকে
রোগবালাই নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয়। সম্প্রতি গাছে আঠাঝরা রোগসহ কয়েকটি রোগের কারণে প্রচুর গাছ নষ্ট হয়েছে। এ বছর মৌসুমের শুরুতে বাগানে বাগানে পরাগায়ন সমস্যার বাইরে ব্যাপক হারে ফুদকি পোকার আক্রমণে মহালাগা রোগের বিস্তার ঘটে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বালাই দমনের নামে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। মৌমাছির অভাবে এ বছর রেকর্ডসংখ্যক মুকুল এলেও পরাগায়নে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে কয়েকটি জেলায় মুকুলে মুকুলে চিনি স্প্রে করার ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার কারণেও হাজার হাজার বিঘার শত শত মণ আম বিকৃত হয়ে গেছে। ভাটার কালো ধোঁয়ায় সৃষ্ট 'ব্ল্যাকট্রিপ' রোগে আক্রান্ত আম নিয়ে বিপাকে এখানকার চাষিরা।
গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সফিকুল ইসলাম জানান, ইটভাটার চিমনি থেকে বের হওয়া বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আম চাষে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। চিমনি থেকে বের হওয়া কার্বন মনোক্সাইড, ইথিলিন গ্যাস আমকে আঘাত করলে বা স্পর্শে এলে আমের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। আম নিজস্ব গঠন অনুযায়ী বেড়ে উঠতে পারে না। নিচের অংশ বিকৃত আকার ধারণ করে। শুধু তা-ই নয়, ধোঁয়ার কারণে আমের নিচের অংশ হলুদ আকার ধারণ করে এবং পরে তা কালো হয়ে যায়। যার শেষ পরিণতি পচন। ইটভাটার কালো ধোঁয়া বাগানকে আক্রান্ত করলে প্রতিলিটার পানিতে পাঁচ থেকে ১০ গ্রাম বোরিক এসিড মিশিয়ে চার থেকে পাঁচবার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

গবেষণা
১৯৮৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯০ বিঘা জমির ওপর আম গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। দীর্ঘ গবেষণায় কেন্দ্রের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে নানা কথা থাকলেও সাতটি নতুন জাতের উদ্ভাবন হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, জনবল সংকট আর নানামুখী জটিলতা নিয়েই এখানে চলছে গবেষণা কার্যক্রম।

শেষ কথা
আমের মৌসুম মানেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরগরম। কিন্তু ফলন যদি হয় বাম্পার তখন গোটা জেলায়ই চলে বাহারি জাতের সুস্বাদু ও রসাল আমের মহোৎসব। আমশিল্পকে ঘিরে কয়েক বছরে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একাধিক ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠলেও স্থানীয়দের দাবি, আম সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; কিন্তু সে দাবি আলোর মুখই দেখছে না।

তথ্য সুত্র : কালের কন্ঠ